সাদিক এগ্রো: পর্দার আড়ালে মেয়র আতিকের ভাতিজা শাকের (ভিডিও)
বংশ মর্যাদা সম্পন্ন কোটি টাকার গরু দিয়ে আলোচনায় আসার পর ছাগলকাণ্ড দিয়ে ইতোমধ্যে বহুদূর গিয়েছে সাদিক এগ্রো। ১২ লাখ টাকায় ছাগল কেনা রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর পরিবারকে দেশছাড়া করে উচ্ছেদ হয়েছে নিজেও। কিন্তু কোটি টাকায় সেই বংশমর্যাদাসম্পন্ন গরু কেনা শাকের আহমেদ আছেন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই। শাকের সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের ভাতিজা এবং তার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শাকের প্রতি কোরবানিতেই কেনেন সাদিক এগ্রোর সেরা গরু। তথ্য বলছে, সাদিক এগ্রোর উত্থানের পেছনেও আছে তার হাত।
সাদিক এগ্রোর প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আমেরিকান ব্রাহমা জাতের সবচেয়ে বড় গরুটি লাইভে শাকের আহমেদের কাছে বিক্রি করছেন এগ্রো মালিক ইমরান। সেই ভিডিওতে কোটি টাকায় গরু কেনা শাকের আহমেদ হজে যাচ্ছেন বলেও উল্লেখ করা হয়। তবে ভিডিওতে শাকেরের পক্ষে গরুটি গ্রহণ করেন তার শ্যালক নাজিবুল্লাহ।
ছবি: মেয়রের ভাতিজা শাকেরের পক্ষে কোটি টাকার গরুটি গ্রহণ করেন তার শ্যালক নাজিবুল্লাহ
কে এই শাকের আহমেদ?
শাকের আহমেদ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। রক্তের সম্পর্কে তিনি মেয়র আতিকুল ইসলামের ভাতিজা।
ছবি: সাদিক এগ্রোর ইমরান আহমেদের (ডানে গোল চিহ্নিত) সঙ্গে শাকের আহমেদ (বায়ে গোল চিহ্নিত) সঙ্গে শ্যালক নাজিবুল্লাহ (মাঝে)
আরও জানা যায়, শাকের শুধু এই বছরই নয় সর্বোচ্চ দামে সাদিক এগ্রোর সেরা গরুটি কিনেছেন ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২২ সালেও। শুধু দামি গরু কেনাই নয়, সাদিক এগ্রোর সুখ-দুঃখে সবসমসয় অগ্রভাগে দেখা গেছে মেয়রের এই ভাতিজাকে। সাদিক এগ্রো মালিক ইমরানের সঙ্গেই সব সময় থাকেন শাকেরের শ্যালক নাজিবুল্লাহ। আমেরিকা থেকে অবৈধভাবে ব্রাহমা গরু আনার সময়ও তিনি সাথে ছিলেন। প্রতি বছর ঈদে গরু বিক্রিতেও ইমরানের সঙ্গে থাকতেন শাকেরের শ্যালক নাজিবুল্লাহ। এগ্রো ফার্মটিতে তার আর্থিক সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া যায়।
সরেজমিন পর্যালোচনা এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু জায়গা দখল করে খামার গড়াই নয়, ধীরে ধীরে খামারের বর্জ্য ফেলে রামচন্দ্রপুর খালটি ভরাটে সহযোগিতা করে সাদিক এগ্রো। বিষয়টি বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনের নজরেও এনেছে অনেকে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো মেয়রসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা গিয়ে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। খোদ মেয়রও গিয়েছেন তাদের বিভিন্ন সভায়। যার মূল কারণ ছিলো ভাতিজা ও তার শ্যালকের সম্পৃক্ততা।
যদিও সম্প্রতি তীব্র সমালোচনা শুরু হলে আগ বাড়িয়ে গিয়ে খালের জায়গায় থাকা সাদিক এগ্রোর খামারটি ভেঙে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। উচ্ছেদের দিন থেকেই এগ্রো মালিক ইমরান বলে আসছেন এতে তার কোনো ক্ষতি হয়নি। কেননা তার প্রতিষ্ঠান এখানে ভাড়ায় রয়েছে। পরিবেশকর্মীরাও বলছেন, খাল ভরাটের ঘটনায় এতোদিন কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে হঠাৎ এসে আসপাশের সব ঠিক রেখে শুধু ভাড়ার ঘরটি ভেঙে দেওয়া এক ধরনের স্টান্টবাজি। এটিকে দায় থেকে বাঁচার চেষ্টা বলেও মনে করেন অনেকে।
তবে রামচন্দ্রপুর খালের ওই অংশের দখলদার শুধু সাদিক এগ্রো নয়। এখানে সর্বপ্রথম দখল শুরু করে মিনা বাজার। পরে সেই ভরাটকৃত জায়গায় ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) প্রতিষ্ঠা করে দখলকে আরও পোক্ত করা হয়। ইউল্যাবের দেখাদেখি আশপাশে আরও গড়ে উঠেছে অনেক ভবন। তবে সাদিক এগ্রোসহ বস্তি উচ্ছেদ হলেও খালের ঠিক মাঝে এখনো দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের স্কুল সুরের ধারা। সেখানে গিয়ে থেমে গেছে উচ্ছেদ অভিযান। আবার এই স্কুলের সামনে খালের জমিতেই সিটি করপোরেশনের খেলার মাঠ হবে বলে ঘোষণা দিয়ে অন্তত ৮-১০টি সাইনবোর্ড দিয়েছে নগর প্রশাসন। যাকে চরম দুরভিসন্ধিমূলক বলছেন স্থানীয় জনগণ ও বিশেষজ্ঞরা।
ছবি: যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রাহমা জাতের গরু আনার সময় সাদিক এগ্রো মালিক ইমরানের সঙ্গে শাকেরের শ্যালক নাজিবুল্লাহ
আব্দুস সাত্তার নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, খাল নাম হলেও এখানে পুরো এলাকাজুড়ে নদীর মতো ছিলো। বড় বড় জাহাজে করে বালু আনতো, আমরা এসে দেখতাম। প্রথমে বালু এনে এনে মিনা বাজার এটা দখল করে। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছে। ২০০৪-২০০৫ সালের পর এটা ভরাট শুরু হয়। এখানে খালের উপর একটা ট্রাক স্ট্যান্ডও বানানো হয়। সম্ভবত ২০১৭ বা ২০১৮ সালে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। কদিন পরে দেখি সুরের ধারা স্কুল এসে আবার খালের মাঝখানে ঘর তুলে বিশাল জায়গা নিয়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে। শুনলাম তাকে নাকি সরকার বরাদ্দ দিছে। তাহলে লাভ কি হলো। এখনো একই অবস্থা, সাদিক এগ্রো ভাঙছে কিন্তু খালতো চালু হলো না। তাহলে ভেঙে লাভ কি হলো?
জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেকজন বলেন, উচ্ছেদ যখন করবেন পুরোটা উচ্ছেদ করে খালটাকে চালু করে দিবেন। খাল চালু না করে এভাবে লোক দেখানো উচ্ছেদ আর গরিব মারা উচ্ছেদের কোনো মানে হয় না।
মনিরুল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, কাকে দোষী বলবো? আজকে যারা সাদিক এগ্রো ভাঙলো তারাইতো এতদিন এখানে আসছে-গেছে। খালের যেখানে মোহনা ছিলো সেখানে এখন দেখছি সিটি করপোরেশন আবার মাঠ বানানোর সাইনবোর্ড দিয়েছে। আর ইউল্যাবতো বহু দূরের কথা খালের মাঝখানের রেজওয়ানার স্কুলটাওতো ভাঙলো না। এগুলো সব ভাওতাবাজী।
এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাভিশনকে বলেন, এই খালের দখল নিয়ে আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছিলাম। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সিটি করপোরেশনের নিরবতা ছিল। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা উঠলো, হঠাৎ গিয়ে তারা শুধু একটা খামার আর বস্তির ঘর ভাঙলো। অথচ খালের মাঝেই গানের স্কুল রয়ে গেলো, ইউল্যাবের দখলকৃত অংশ এবং বহুতল ভবনও রয়ে গেছে। এখন আবার দেখছি সেখানে খেলার মাঠ করার সাইনবোর্ড দিয়েছে নগর প্রশাসন। সহজেই বলা যায়, এটা দুরভিসন্ধিমূলক।
তিনি বলেন, এই খালের যারা দখলদার তাদের সঙ্গে মেয়রের বহু সখ্যতা আমরা দেখেছি। ছবি দেখেছি। এসব কারণেইতো এতবার বলার পরও উচ্ছেদ হয়নি। বরং মেয়রসহ বড় বড় সরকারি কর্মকর্তারা গিয়ে তাদের অবৈধ খামার উদ্বোধন করেছে। এজন্যইতো আমরা বলি, প্রভাবশালীদের কারণে নদী-খালের দখল উচ্ছেদ হয় না। এর দায় কোনোভাবে নগর প্রশাসন এড়াতে পারে না।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, আমি কমিশনে থাকাকালে ২০১৮ সালে ডিসি, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে স্পটে গিয়ে দেখিয়ে এসেছি কারা কারা দখলদার। সেগুলো উচ্ছেদ করতে লিখিত নোটিসও দিয়েছি। কিন্তু এতদিন তারা করেনি। যাইহোক, এখন যে শুরু করেছে সেটাকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু অল্প একটু করে থেমে গেলে এটাকে কোনো কাজ বলা যায় না।
নদী-খালের জমি জনগণের সম্পত্তি, তাছাড়া দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এটাকে জীবন্ত সত্ত্বা বলেছেন। নদী-খাল কাউকে বরাদ্দ দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এটা ফৌজদারী অপরাধ, সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আদালত অবমাননাও। আমি মনে করি শুধু একটা খামার নয়, খালের ওপর গড়ে তোলা ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়, সুরের ধারা স্কুলসহ যা যা আছে সব উচ্ছেদ করা সরকারি সংস্থাগুলোর সাংবিধানিক দায়িত্ব। আর খালের মধ্যে মাঠ বা থানা করাতো স্টুপিড কাজ।
সাদিক এগ্রোর সঙ্গে ভাতিজার সম্পর্ক, জলাভূমি দখলে নিরবতা এবং খোদ সিটি করপোরেশনের নামে খাল দখলের অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে বার বার চেষ্টা করা হলেও ব্যস্ততার অযুহাতে এড়িয়ে গেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। সবশেষ সোমবার (৮ জুলাই) বিকালে মেয়রের পরিবর্তে সিইও কথা বলবেন বলে প্রতিবেদককে জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে নগর ভবনে গিয়ে জানা যায়, চীন সফরে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে তাকেও কথা বলতে নিষেধ করে গেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।
সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন জেলা প্রশাসকও। অপরদিকে মেয়রের ভাতিজা শাকের আহমদও দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বিভি/এমআর
মন্তব্য করুন: