• NEWS PORTAL

  • বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

৫০০ বছরের ঐতিহ্য বাঘা শাহী মসজিদ

পরিতোষ চৌধুরী আদিত্য 

প্রকাশিত: ১৫:৫২, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আপডেট: ১৬:২০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ফন্ট সাইজ
৫০০ বছরের ঐতিহ্য বাঘা শাহী মসজিদ

দেশের আকর্ষণীয় মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম অপরূপ টেরাকোটার নকশায় খচিত রাজশাহী বাঘার শাহীমসজিদ। যে মসজিদের ছবি ৫০ টাকার নোট ও ১০ টাকার স্মারক ডাক টিকেটে দেখতে পাওয়া যায়।  

হজরত শাহ দৌলাহ (রহ.)-এর মাজার আর প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন সমৃদ্ধ দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান রাজশাহীর বাঘা। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন শাহী মসজিদ এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। ঐতিহ্যবাহী মসজিদ ঘিরে সুবিশাল দীঘি, প্রাচীন অন্দরমহল, পুকুরের ধ্বংসস্তুপ, হজরত আবদুল হামিদ দানিশমান্দ (রহ.), হজরত মুয়াজ্জেম দানিশমান্দ (রহ.), শাহ দৌলাহ (রহ.)-এর মাজার ভ্রমণপ্রিয় এবং ধর্মানুরাগী মানুষের জন্য এক সেরা আকর্ষণীয় স্থান। 

আরও পড়ুন: পটুয়াখালী শত বছর পুরনো বড় জামে মসজিদের পুননির্মাণ কাজের উদ্বোধন 

শাহী মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে লাল পোড়া মাটির কারুকার্যশোভিত সুন্দর দুটি ফটক। প্রবেশ করলেই দেখা মিলে সবুজে ছাওয়া আঙিনা, আমগাছের ডালে হাজারো পাখির কলকাকলি, দীঘির নিটোল জলে পাতিহাঁসের ভেসে বেড়ানোর অপূর্ব দৃশ্য। সত্যি মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাজার বছর আগে বাগদাদের আব্বাসীয়া আমলের খলিফা হারুনুর রশীদের বংশধর হযরত মওলানা শাহ আব্বাসের পুত্র হযরত মওলানা শাহ মুয়াজ্জিম উদ্দৌলা ওলি ঘরসংসার ত্যাগ করে রাজশাহীর বাঘার গহীন অরণ্যে আস্তানা গাঁড়েন। তিনি পরিচিত হযরত শাহদৌলা (র.) নামে। বাঘায় এসে তিনি ইসলাম প্রচারের স্বার্থে অধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন। ওই সময় ঐতিহাসিক এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।

পরবর্তীতে ১৫২৩-১৫২৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নসরাত শাহ প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির ওপর মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদের সংস্কার করা হয়। মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙে গেলে ১৮৯৭ সালে নতুন করে আবার ছাদ ও গম্বুজ নির্মাণ হয়। বাঘা মসজিদের ছবি ৫০ টাকার নোট ও ১০ টাকার স্মারক ডাক টিকেটে দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদের চারপাশটাই বিশাল দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সমভূমি থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। দেওয়াল প্রায় ৮ ফুট চওড়া। সবটাই লাল পোড়ামাটির আস্তরণ। দেওয়ালের গায়ে সুন্দর করে আঁকা হয়েছে আমগাছ, শাপলা ফুল ও লতাপাতার অপূর্ব কারুকাজ। সবকিছুই অপরূপ টেরাকোটার নকশায় খচিত। প্রধান ফটক থেকে এসবের নির্মাণশৈলী দর্শনার্থীদের টেনে নিয়ে যায় মসজিদের ভেতরে। 

মসজিদটির ওপরে রয়েছে মোট ১০টি গম্বুজ ও চারটি মিনার। ভেতরে রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ ও সুন্দর কারুকার্য খচিত চারটি মেহরাব। মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি রয়েছে।

মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত হয়েছে একটি বিশেষ নামাজ কক্ষ। অনেকে মনে করেন, এটি আগে মহিলাদের নামাজের জায়গা ছিল। আবার অনেকের মতে, কক্ষটি কেবল সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। মসজিদের পাশেই আছে একটি কবরস্থান। বেশ কয়েকজন বুজুর্গ শায়িত আছেন এখানে। কথিত আছে, হজরত শাহ দৌলাহ দানেশমন্দ (রহ.) পাঁচজন সঙ্গীসহ ১৫০৫ সালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাঘায় আসেন। খানকা গড়ে এখানেই থেকে যান। ইন্তেকাল করলে বাঘা মসজিদের এই মাজারে মাদফুন হোন।নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনেই একটি দীঘি খনন করেন। শাহী মসজিদ সংলগ্ন এ দীঘিটি ৫২ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত। দীঘির চারপাশে রয়েছে অসংখ্য নারিকেলবীথি। প্রতি শীত মৌসুমে দীঘিতে বেড়াতে আসা অসংখ্য অতিথি পাখির কলতানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। দীঘিটির চারপাশে রয়েছে বাঁধানো পাড়। 

তবে কিছু কিছু জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে। ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অনূরুপ নকশা প্রতিস্থাপন করে সিরাজগঞ্জের কারুশিল্পী মদন পালকে দিয়ে। ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে বাঘা শাহী মসজিদের ক্ষতি হয়। ভেঙে পড়ে ওপরের ১০টি গম্বুজ। তারপর থেকে দীর্ঘদিন মসজিদের ভেতরটা পরিত্যক্ত ছিল। পরে গম্বুজগুলো পুননির্মাণ করা হয় ১৯৭৬ সালে।

মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে জহর খাকি পীরের মাজার। ১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশ খনন করার সময় ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মিলে। পুকুরটি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সম্প্রতি মোজাইক বিশিষ্ট এখানে আরও দুটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে নামাজ পড়েন মহিলারা। 

জনশ্রুতি আছে, কোনো এক সময়ে অতিথি আপ্যায়নের জন্য মানুষ দীঘির কিনারে গেলে ডেকসি, থালাবাসন প্রভৃতি পানির নিচ থেকে ভেসে উঠত। সেগুলো নিয়ে অতিথি আপ্যায়ন শেষে অবার দীঘিতে রেখে যেত। কোনো এক ব্যক্তি ওই সব জিনিস ফেরত না দেয়ার ফলে ভেসে ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। কথিত আছে, পানির উছিলায় বিভিন্ন বালা মুছিবত দূর হয়। ফলে হাজার হাজার মানুষ দীঘি থেকে পানি নিয়ে যান। এক সময় শীত মৌসুমে এই দীঘিতে অসংখ্য অতিথি পাখির আগমনে ও কলতানে এলাকা মুখরিত হয়ে উঠত। দীঘির চারপাশে সারিবদ্ধ অসংখ্য নারিকেল গাছ। 

এর পাশে রয়েছে বাঘা ডাকবাংলো ও হাজার বছরের ঐতিহাসিক তেঁতুল গাছ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানে এক সময় এশিয়া মহাদেশের একমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখান থেকে সামান্য দক্ষিণে গেলে দেখা যাবে প্রমত্তা পদ্মার শাখা নদী। 

রাজশাহী শহর থেকে ৫০ কিলোমিটারে দক্ষিণ-পূর্বে এলেই দেখা মিলবে ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদ। রাজশাহী শহর থেকে বাস ও বিভিন্ন ছোট যানবাহনে যাওয়া যায় সেখানে। বাস ভাড়া জনপ্রতি ৯০ টাকা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজশাহী শহরের প্রবেশের আগে পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাসস্ট্যান্ডে নেমেও ঐতির্য্যবাহী শাহী মসজিদে যাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে বাস ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা ও সিএনজি ভাড়া ৭০ টাকা। সরকারি বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এখানে মসজিদ দর্শন ও মাজার জিয়ারত এবং নামাজ আদায় দূর-দূরান্তের লোকজন ছুটে আসেন। প্রতি ঈদেও এখানে লক্ষাধিক লোকের আগমন ঘটে। দিন দিন মসজিদের পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে চলছে। দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত এই দৃষ্টিনন্দন স্থানটি। পর্যটন করপোরেশনের আওতায় বাঘায় পর্যটন উপযোগী কিছু উদ্যোগ নিলে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকের কাছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এবং সরকার এখান থেকে অনেক টাকার রাজস্ব আয় করতে পারে। 


 

বিভি/রিসি

মন্তব্য করুন: