পুলিশের ধাওয়ায় টাকা নিয়ে নিখোঁজ জিয়াউর, ৭ দিন পর মরদেহ উদ্ধার নিয়ে জনমনে প্রশ্ন

নিহত জিয়াউর রহমান জিয়া
পাবনা বেড়ায় জুয়ার আসর থেকে পুলিশের ধাওয়ায় নিখোঁজ হয় জিয়াউর রহমান জিয়া (৪৭) নামে এক জুয়ারি। নিখোঁজের সাতদিন পর বুধবার (২৭ সেপ্টম্বর) রাতে ঐ ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
উপজেলার নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের চর এলাকার আগবাগশোয়া গ্রামের একটি নালা থেকে মরদেহটি উদ্ধার হয়। নিহত জিয়াউর রহমান উপজেলার আমিনপুর থানাধীন ঢালারচর কাজীপাড়া গ্রামের আজিজুল কাজীর ছেলে। নিহতের পরিবারের দাবি জিয়াকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
পরে ২৮ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সকালে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাবনা মর্গে প্রেরণ করে থানা পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করলে দাফন করেন স্বজনরা।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, জিয়াউর রহমান নিখোঁজ হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। এ ঘটনায় প্রথমে বেড়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে পুলিশ এতে আপত্তি জানায়। পরে তার ভাই আজাদ কাজী ২৩ সেপ্টেম্বর আমিনপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। যার জিডি নং- ১৮০৯।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বেড়া থানাধীন নতুন ভারেঙ্গা ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের চরসাফুল্লাহপুর গ্রামের জয়বাংলা বাজারে প্রভাবশালী আমজাদ মোল্লার নেতৃত্বে দীর্ঘদিন জুয়ার আসর বসত। উপজেলার নগরবাড়ি, রাকসা, বেড়া, ঢালারচর, আমিনপুর, সুজানগর, দুরদূরান্তের জুয়ারিরা জুয়া খেলতে আসত। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার খেলা চলত সেখানে।
থানা পুলিশকে ম্যানেজ করার জন্য জুয়ার আসর থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা তুলতেন এলাকার প্রভাবশালী নেতা আমজাদ মোল্লা। এরপর পুলিশকে যাতে টাকা না দিতে হয় সে কারণে গত ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কৌশলে জুয়া খেলার স্থান পরিবর্তন করে জয়বাংলা বাজারের পাশেই পূর্ব শ্রীকন্ঠদীয়া গ্রামে খেলা শুরু করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানায়, জুয়া খেলার যায়গা পরিবর্তন করার পর ঐ দিন দুপুরে বেড়া মডেল থানার এ এস আই আনোয়ার হোসেন পুলিশের ফোর্সসহ সেখানে উপস্থিত হয়ে চারজন জুয়ারিকে আটক করে। আর বাকি চারপাচঁজনকে পুলিশ ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়। তবে পুলিশ আসার কয়েক মিনিট আগেই আমজাদ সটকে পরে। আর থানায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আটককৃতরা ছাড়া পায় বলে অভিযোগ।
পুলিশের দাবি চারজনকে থানায় এনে পরবর্তিতে জুয়া না খেলার মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শিরা জানান, পুলিশ তিন-চারজনকে ধাওয়া করলে মকবুল নামের এক জুয়ারি পালানোর সময় আগবাগশোয়া গ্রামের একটি নালায় ঝাঁপ দিলে ২৯ হাজার টাকা পানিতে পরে যায়। সে দৌঁড়ানোর সময়ে ঐ এলাকার লোকজনকে বলে যায় যে ঐ নালায় আমার ২৯ হাজার টাকার হারিয়েছে তোমরা খুঁজে নিও, এতে আমার কোন চাওয়া পাওয়া নাই। তোমরা নিয়ে নিও। তার পরদিন থেকে ঐ নালায় দুইদিন চলে টাকা খুঁজার হিড়িক এবং সবার তথ্য মতে প্রায় ২২ হাজার টাকা পায় লোকজন।
এদিকে তখন থেকেই নিখোঁজ হয় জিয়াউর রহমান। পরদিন জিয়াকে খুঁজতে তার গ্রাম থেকে শত শত মানুষ আসেন চর এলাকায়। দুইদিন চরের বিভিন্ন এলাকায় খুঁজে তার কোন সন্ধান মেলে না। এ ঘটনার সাতদিন পর চর এলাকার আগবাগশোয়া গ্রামের সেই নালা থেকে একজন মানুষের মরদেহ উদ্ধার করেন পুলিশ। তবে মরদেহের পাশে পরে থাকা লুঙ্গি ও জিয়াউরের পড়নের গেঞ্জি দেখে চিনতে পারেন তার ছেলে আব্দুর রহিম ও তার চাচা আজম কাজী।
জিয়াউরের ছেলে আব্দুর রহিম বলেন, যেই নালায় মরদেহটি পাওয়া গেল সেখানে দুইদিন লোকজন টাকা খুঁজলো তখন কারো চোখে পড়লো না। আর এখন এখানে বাবার লাশ আসলো কিভাবে। তাও আবার প্রায় কঙ্কাল। আর লাশের পাশে বস্তা দেখেতো বুঝাই যায় বাবাকে অন্য জায়গা থেকে কে বা কারা হত্যা করে এখানে ফেলে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসি জানান, আমজাদ মোল্লা একজন প্রকৃত জুয়ারু। সে প্রভাবশালী হওয়াতে তার অত্যাচারে চর এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। পুলিশকে ম্যানেজ করা ছাড়া জুয়া খেলা অসম্ভব। জুয়ার কারণে অনেক পরিবার ঋণগ্রস্থ হয়ে এলাকা ছেড়েছে। জুয়া খেলা একেবারে বন্ধের পাশাপাশি এ ঘটনার আসল রহস্য উদঘাটনের জন্য প্রশাসনের উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
নিহতের চাচা আজম কাজী জানান, ‘পুলিশের ধাওয়াতেই জিয়া নিখোঁজ হয়েছিল। আমার ভাতিজাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারণ ও নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন আমাদের এলাকার প্রায় দুই শত লোক খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও পাইনি। যেখানে লাশ পাওয়া গেল সেখানেও খুঁজেছিলাম। জিয়ার ভেকু গাড়ি বিক্রি করা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল।
নিহত জিয়ার স্ত্রী রহিমা খাতুন কান্নাজরিত কন্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামী বাড়িতে থাকা টাকাসহ ভেকু বেচা টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। আমার স্বামীও নাই টাকা পয়সাও নাই। তাকে হারিয়ে পাগল হয়ে গেছি। আমার সোনার সংসারে তিন ছেলে এক মেয়ে তাদেরকে কিভাবে লালন-পালন করবো সংসার চালাবো কিভাবে ভেবেই পাচ্ছি না। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের বিচার চাই’।
এ বিষয়ে নতুন ভারেঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আবু দাউদ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘আমি ঐ দিন শুনলাম চরসাফুল্লা জুয়ারুদের পুলিশ ধাওয়া করেছে আর চারজনকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে। পরে জানলাম আটক করা চারজনের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তার দুইদিন পর শুনি পুলিশের ধাওয়ায় একজন নাকি নিখোঁজও হয়েছে। ঢালারচর থেকে অনেক লোকজন এসে তাকে দুইদিন ধরে খুঁজেছে। সাতদিন পর শুনি আগবাগশোয়া গ্রামের একটি নালার পাশে মানুষের মরদেহ পাওয়া গেছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। পুরো ঘটনাটাই আমার কাছে রহস্যজনক বলে মনে করছি’।
এ বিষয়ে জুয়ার নেতৃত্ব দাতা আমজাদ মোল্লার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। তার ফোন বন্ধ। ঘটনার পর থেকে পলাতক তিনি।
বেড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হাদিউল ইসলাম বলেন, ‘ওইদিন পুলিশ কাউকে ধাওয়া করেনি। তবে জুয়ার আসর বসার খবর পেয়ে পুলিশ অভিযান চালায়। কিন্তু দূর থেকে পুলিশের নৌকা দেখে জুয়ারিরা দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। নিখোঁজ জিয়াউরের লাশ ৬ দিনের ব্যবধানে কঙ্কালে রুপ নেওয়া অস্বাভাবিক। ময়নাতদন্ত শেষে বুঝা যাবে ঘটনার রহস্য কি।
বিভি/রিসি
মন্তব্য করুন: