হাজী সেলিমের দখলে অর্ধশত বাড়ী, নদীর জায়গায় বানাচ্ছেন কোটি টাকার জাহাজ
১৯৫৮ সালের ৫ অক্টোবর পুরান ঢাকায় জন্ম হাজী মোহাম্মদ সেলিমের। পড়ালেখা মাত্র নবম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে পাস করেছেন কি না, তা জানা যায়নি।
স্বাধীনতার আগে হাজী সেলিমের বাবা চান মিয়া ছিলেন সোয়ারীঘাটের পান বিক্রেতা। পিতার সঙ্গে পান বিক্রির মধ্য দিয়ে ব্যবসা জগতে পা রাখেন তিনি। স্বাধীনতার পরও পান বিক্রি করেই সংসার চলত এই পরিবারের। একপর্যায়ে কোমলপানীয় সেভেন আপের এজেন্সি খুলেন। ওই এজেন্সির আড়ালে নকল কোমলপানীয় বিক্রির অভিযোগে মোহাম্মদ সেলিম, তার বাবা চান মিয়া ও বড় ভাই কায়েস মিয়াকে আটক করে পুলিশ।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে মদিনা ট্রেডিং করপোরেশন নামে সিমেন্টের ব্যবসায় নামেন মোহাম্মদ সেলিম। শুরুর দিকে বাদামতলী থেকে জমাটবাঁধা সিমেন্ট এনে তা ক্র্যাশ করে বিক্রি করতেন তারা। একপর্যায়ে নিজেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে সিমেন্ট কারখানা খুলেন। সিমেন্টের সঙ্গে বালি ও মাটি মিশিয়ে বাজারজাত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি-আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়কে কাজে লাগিয়ে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের পান ব্যবসায়ী থেকে হাজী মোহাম্মদ সেলিম হয়ে উঠেন মদিনা গ্রুপের মালিক। একপর্যায়ে ফলের ব্যবসা শুরুর মধ্য দিয়ে বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাট এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন তিনি। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজী সেলিমের নাম। অন্যায় অনিয়মের পথ ধরেই তার উত্থান। আর নিজের সেই উত্থান আরও এগিয়ে নিতে রাজনীতিকে ‘মই’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বেছে নিয়েছেন ‘ক্ষমতার রাজনীতি’।
নব্বইয়ের দশকে বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজী সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন পেয়ে লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর নির্বাচনী এলাকার এমপি হন হাজী সেলিম। এরপর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে তার ব্যবসা ও সম্পত্তির পরিমাণ। পুরান ঢাকার স্থানীয়রাও জানান তার অপকর্মের কথা।
এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জমি ও বাড়ি দখলের নেশায় পেয়ে বসে হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই সময় হাজী সেলিম পাড়া-মহল্লায় পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেন। স্থানীয়রা জমি বা বাড়িসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে তার সহযোগিতা চাইতে গেলে বিরোধ নিষ্পত্তির বদলে হাজী সেলিম জোর পূর্বক এবং ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে ওই জমির কাগজপত্র কিনে নিতেন। এক পর্যায়ে ঘরে বা দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। এজন্য তার নাম হয় ‘তালা হাজী’।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেলখানার পাশে ৬০-৭০ বছরের পুরনো ব্যবসায়ীদের জোর করে উচ্ছেদ করে নির্মাণ করেন মদিনা আশিক টাওয়ার ও হাজী সেলিম টাওয়ার নামে দুটি বহুতল ভবন ও মার্কেট। উচ্ছেদে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মার্কেট নির্মাণের শেষে নতুন দোকান দেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অনেককেই দেননি। এই কারণে ওই সময়ে দুজন ব্যবসায়ী আত্মহত্যাও করেন বলে জানায় স্থানীয়রা।
মদিনা আশিক টাওয়ারের জমির মূল মালিক ছিলেন হাজী মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ। স্থানীয়রা জানান, তার থেকে জোর করে ওই জমি দখলে নেন হাজী সেলিম। এখানেই পজিশন নিয়ে ১৯৮৮ সাল থেকে ব্যবসা করতেন মোহাম্মদ ইউছুব মিয়া। তার বড় ছেলে ইয়াকুবের নামেই দোকানের দাখিলা দিয়েছেন ২০১০ সাল পর্যন্ত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই প্রবল শক্তি নিয়ে দখলে মেতে উঠেন হাজি মোহাম্মদ সেলিম।
স্থানীয়রা বলছেন, যেখানেই চোখ পড়েছে হাজী সেলিমের, সেটাই দখল করে নিয়েছেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে পরিচিত চকবাজারের শতবর্ষেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্যবাহী দোতলা জাহাজবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম। ২০১৯ সালের ১৫ জুন ঈদের ছুটিতে এক রাতের মধ্যেই দখল হয়ে যায় শত বছরের সাক্ষী এই ভবনটি। ভাঙতে গিয়ে ব্যাবসায়ীদের মালামালও লুট করে নিয়ে যান তিনি। পথে বসে যায় শত শত ব্যবসায়ী। এরপরে গড়ে তোলেন বড় ছেলের নামে সোলায়মান সেলিম টাওয়ার।
বুড়িগঙ্গার তীরে চাঁদনীঘাটে ওয়াসার জমি দখল করে সেখানে পেট্রলপাম্প তৈরি করেন হাজী সেলিম। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন কামালবাগের জমির কাগজপত্র জালিয়াতির হোতা হিসেবে পরিচিত হাফেজ কামাল। সোয়ারীঘাটে নদী তীর দখল করে সেখানে গড়ে তোলেন চাঁদ সরদার কোল্ড স্টোরেজ। ১৯৯৬ সালে নবাব পরিবারের জমি দখল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তিব্বত হল, শহীদ আরোয়ার শফিক হল এবং অগ্রণী ব্যাংকের জমি দখল করে স্ত্রীর নামে তৈরি করের গুলশান আরা মার্কেট।
আরমানিটোলায় এক বৃদ্ধার সম্পত্তি দখল করে নির্মাণ করেন এমটিসি টাওয়ার। নলগোলায় ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি দখল করে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন। এভাবেই হাজী সেলিম রাজধানীর পুরান ঢাকার বাদামতলী, নবাববাড়ী, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর রোড, ইমামগঞ্জ, ইসলামপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ফতুল্লা এলাকায় জমিজমার মালিক হন।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ষাটোর্ধ্ব ক্বারী সাখাওয়াত হোসেন। দীর্ঘ সময় পানিবন্দি তিনি। এমন পরিণতিতে হাত রয়েছে হাজী সেলিমের। তার ভিটাবাড়ির সাড়ে পাঁচ শতাংশ জমি হাজী সেলিম তার নামে খতিয়ানভুক্ত করে নেন। মামলায় জমি ফেরত পেলেও নামজারি করতে পারেননি। এখন মামলা করে এই ক্বারীসাহেবের পরিবারকে হয়রানি করছে। পরিবার নিয়ে এখন আতঙ্কে জীবন কাটছে তাদের।
দখল এখানেই শেষ নয়, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁওয়ের মেঘনা এলাকায় সড়ক জনপদের জমি দখল করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন হাজী সেলিম।
কেরানীগঞ্জের বসিলার ঝাউচর এলাকায় দখল করে মদিনা মেরিটাইম লিমিটেড হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে। চারটি জাহাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে লাগানো হয়েছে আকাশমনি, রেইনট্রিসহ নানা জাতের গাছ। ছবি তুলতে গেলে এখানকার কর্মচারীরা ছবি তুলতে নিষেধ করেন। একপর্যায়ে হাজী সেলিমের পিএস বেলাল ফোন করে অনুরোধ জানান ছবি না তুলতে। বলেন, নদীর এই জমি হাজি সেলিম ভরাট করেননি। তিনি বিআইডাব্লিউ থেকে লিজ নিয়েছেন। অথচ বিআইডাব্লিউটিএর কাছে এমন কোনো তথ্যই নেই।
এই জায়গার আরেকপাশে রাখা আছে পাথর। এসব পাথর পদ্মাসেতুর রেল লাইনে সরবরাহ করে মদিনা মেরিটাইম। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজসে হাজি সেলিমের বিশ্বস্ত মদিনা মেরিটাইম লিমিটেডের সিনিয়র জিএম কামরুল হাসান পদ্মা সেতুর রেলে নিম্নমানের এবং পরিমানে কম পাথর দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এখন নিজেকে সেইভ করতে আমেরিকা যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। বাকশক্তি না থাকায় এই ম্যানেজারই তার হয়ে সকল কাজের ডিল করেন। ফলে প্রত্যেক কাজেই একদিকে হাজি সেলিম দুর্নীতি করছেন, অন্যদিকে সেলিমকে অন্ধাকারে রেখে সিনিয়র জিএমও দুর্নীতির সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।
হাজী সেলিমের দুর্নীতির সিন্ডিকেটের প্রধান মাস্টারমাইন্ড দুর্নীতিবাজ কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। এখানে নদীতে অবৈধভাবে ঘাট তৈরি করে হাজি সেলিমের বড় বড় জাহাজের মালামাল লোড আনলোড করছেন। যা দেখারও কেউ নেই। দুর্নীতির স্থানীয়রা জানান, এই ঝাউচরে অনেক মানুষের জমিও দখল করেছে হাজি সেলিম।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান তিনি। মনোনয়ন পাওয়ার পর আবার একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে আগের মতোই ক্ষমতার প্রদর্শন ও দখল কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: