জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতার আতঙ্কে কাঁপছে ইনস্যুরেন্স পাড়া (ভিডিও)
গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর ডিআইটি রোডের প্রিন্টার্স বিল্ডিংয়ের ৭ম তলায় অবস্থিত যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে মারমুখী ভঙ্গিতে প্রবেশ করেন কয়েকজন তরুণ। সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কক্ষে প্রবেশ করে নিজেদেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয় দেন তারা। চেয়ারম্যান বদরুল আলমকে হুমকি দিয়ে দাবি জানান, ইনস্যুরেন্সটির সিইও পদে নতুন নিয়োগ পাওয়া বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে অপসারণ করে শিক্ষা সনদ জালিয়াতির দায়ে চাকরি হারানো সংস্থাটির সাবেক সিইও কামরুল হাছানকে পুনর্বহাল করতে হবে।
কিন্তু সরকারি তদন্তে কামরুল হাসানের শিক্ষা সনদ জালিয়াতি প্রমাণ হয়েছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বদরুল আলম তাকে নিয়োগ দেওয়া অসম্ভব বলে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বদরুল আলমকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে বকাবকি করেন ঢাকা কলেজ সমন্বয়ক পরিচয়ে এই দলের নেতৃত্ব দেওয়া মামুনুর রশিদ রতন। এক পর্যায়ে তারা বলেন, কামরুলের নিয়োগের ব্যবস্থা তারা করবেন। আগে বর্তমান সিইও ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। তাদের দাবি না মানলে নিচে আরও ১৫-২০ জন সমন্বয়ক অপেক্ষা করছে বলেও হুমকি দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে তাদের কথামতো বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের নামে চাকরি থেকে অব্যাহতিপত্র দেন চেয়ারম্যান বদরুল আলম। সেই অব্যাহতিপত্রটি নিজেদের সঙ্গে করে নিয়ে যায় এই সমন্বয়ক পরিচয় দানকারীরা।
যদিও ১৫ জানুয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) চিঠি দিয়ে যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় সমন্বয়ক পরিচয়দানকারীদের হুমকিতে আতঙ্কিত হয়ে পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই বর্তমান সিইওকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়েছেন চেয়ারম্যান। তাই বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে চাকরিচ্যুত করে দেওয়া আদেশটি কার্যকর হবে না।
তার আগে এই সমন্বয়ক পরিচয়ধারীরা যায় দিলকুশায় অবস্থিত ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান আইডিআরএ-তে। সেখানেও সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি ধমকি দিয়ে বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের পরিবর্তে সার্টিফিকেট জালিয়াতির দায়ে চাকরি যাওয়া কামরুল হাছানকে যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্সে পুনরায় নিয়োগের দাবি জানায় তারা। কিন্তু আইডিআর জানায়, কামরুল হাসানের সার্টিফিকেট জালিয়াতি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় তার চাকরি আর নবায়ন করা হয়নি। সেই আইনত অপরাধী এবং এই পদের অযোগ্য তাই তাকে নিয়োগের সুপারিশ করা সম্ভব নয়। একইসঙ্গে আইডিআর আরও জানায়, কোনো বীমা কোম্পানিতে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার আইডিআর এর নয়। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিই তাদের নিয়োগ করে। আইডিআরএ’র দায়িত্ব শুধু যেই ব্যক্তি নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন তিনি নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটি দেখা।
বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) পরিচালক (যুগ্ম সচিব) জাহাঙ্গীর আলম বাংলাভিশনকে বলেন, তারা সমন্বয়ক পরিচয়ে অফিসে এসে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে পরিচালকরা কথা বলতে গেলে তারা বলে চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথা বলবে না। তারপর চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে গেলে তারা বর্তমান সিইওকে চাকরিচ্যুত করে সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনায় চাকরি হারানো কামরুল হাছানকে পুনর্নিয়োগ করতে বলে। চেয়ারম্যান স্যার তাদের বুঝিয়ে বলেন যে এটা আমাদের এখতিয়ারে নেই। এটা বীমা কোম্পানির সিদ্ধান্তের বিষয়।
তিনি আরও বলেন, ‘তারা এসে সমন্বয়ক পরিচয় দিলেও তাদের অনেককে দেখে ছাত্রও মনে হয়নি। লিফটের সামনে একজনকে ধরেছিলাম, সে বলছে তার বাবা নিউমার্কেটে সবজি বিক্রি করেন।’
এদিকে যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স থেকে তাদের হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করে বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে চাকরিচ্যুত না করতে বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ায় গত ২৩ জানুয়ারি আবারও প্রতিষ্ঠানটিতে যায় এই সমন্বয়ক পরিচয়ধারীরা। এদিন তারা সংস্থার ভাইস-চেয়ারম্যানকেও হুমকি দেয় বলে অভিযোগ করেছে বীমা প্রতিষ্ঠানটি।
যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সিইও ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল বাংলাভিশনকে বলেন, সমন্বয়ক পরিচয়ে তারা এসে চেয়ারম্যানকে বলেন আমি ইসকনের সদস্য, আমি ইসলাম বিদ্বেষী এবং দুর্নীতিবাজ এজন্য আমাকে সরিয়ে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে বসাতে হবে। চেয়ারম্যান স্যার বৃদ্ধ মানুষ, তাই ভয়ে প্রথমে অব্যাহতিপত্র লিখে দিয়েছেন। পরে অবশ্য তিনি বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে আইডিআরএকে অন্য একটা চিঠিতে পুরো ঘটনা জানিয়ে অব্যাহতিপত্রটি গ্রহনযোগ্য নয় বলে নিশ্চিত করেছেন। কেন আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো না সেটার জন্য হুমকি দিতে তারা গত ২৩ জানুয়ারি আবারও আমাদের অফিসে এসেছিল। এই দলে বেশ কয়েকজন তরুণ এলেও মূলত সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল মামুনুর রশিদ রতন নামের একজন। তিনি নিজেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা কলেজ শাখার সমন্বয়ক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
কে এই মামুন? আসলেই কি তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক? যাচাই করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় বা ঢাকা কলেজ সমন্বয়ক তালিকায় তার নাম পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এই শিক্ষার্থী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবির আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে বেশ পরিচিত।
তিনি সমন্বয়ক কিনা জানকে চাইলে মামুনুর রশিদ রতন বাংলাভিশনকে বলেন, আমি আগে সমন্বয়ক ছিলাম। এখন আমি সমন্বয়ক নেই। আমি এখন জাতীয় নাগরিক কমিটির নিউমার্কেট থানা কমিটিতে যুক্ত। তবে আমি নিজে সমন্বয়ক না হলেও আমার সঙ্গে সেখানে একাধিক সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন।
বীমা কোম্পানি ও সরকারি বীমা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল একজন ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসকন সদস্য। তিনি দুর্নীতিবাজও। আমরা দেশ সংস্কার করছি তাই এই বীমা প্রতিষ্ঠানেরও সংস্কার করতে গিয়েছি। আমাদের জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্র থেকে যমুনা লাইফ ইনস্যুরেন্সে কল করা হয়েছিল। আমি নাগরিক কমিটির দায়িত্বের অংশ হিসেবেই গিয়েছি।
কিছু সময় পরে আবার ফোন করে প্রতিবেদককে হুমকিও দেন এই শিক্ষার্থী। প্রতিবেদককে মামুনুর রশিদ রতন বলেন, আপনি সাংবাদিক কিনা আমি যাচাই করবো। আপনি কেন দুর্নীতিবাজের পক্ষে সাফাই গাইছেন। হোমল্যান্ড ইন্সুরেন্সের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি আছে সেগুলো কি আপনার চোখে পড়ে না? আপনার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে। আপনার ঠিকানা দেন, আমি দলবল নিয়ে আসতেছি।
বীমা কোম্পানিতে সংস্কারের দায়িত্ব দিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি কাউকে পাঠিয়েছিল কিনা এবং কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এভাবে প্রভাব বিস্তার করার এখতিয়ার তাদের রয়েছে কিনা জানতে চাইলে সংগঠনটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিনকে কল করা হলে তিনি খোঁজ নিয়ে জানানোর কথা বলে প্রতিবেদকের কাছ থেকে সময় চান। কিন্তু পরে বার বার কল করা হলেও তিনি আর কল রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে জানতে বাংলামোটরের রূপায়ন টাওয়ারে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে গিয়ে একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললেও সবাই সামান্তা শারমিনকে দেখিয়ে দিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
বিভি/এসজি
মন্তব্য করুন: