সোনারগাঁও ও ইন্টারকন্টিনেন্টালের ৩৯ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

পাঁচ তারকাখ্যাত হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ও সাবেক ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের (রুপসী বাংলা হোটেল) প্রায় ৩৯ কোটি টাকার সম্পূরক শুল্কসহ মুসক বা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এ মর্মে চূড়ান্ত প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) বা ভ্যাট বিভাগ।
দীর্ঘ একযুগ ধরে তদন্ত শেষে আদালতে চূড়ান্ত প্রমাণের ভিত্তিতে হোটেল দুটিকে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৯২ হাজার ২০০ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও এবং ১৮ কোটি ৮৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৯৪ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল।
এনবিআরের এলটিইউ সূত্রে জানা গেছে, ফাঁকি দেওয়া এই টাকা আদায়ে ২০০৯ সাল থেকে আদালতে মামলা বিচারাধীন। চলতি বছর রিট পিটিশনের পর আদালত থেকে চূড়ান্ত রায়ে এলটিইউকে ফাঁকি দেওয়া টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সেই নির্দেশের পর এলটিইউর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী এই হোটেল দুটিকে ভ্যাটের টাকা পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়েছেন। তবে এখনও প্রতিষ্ঠান দুটি টাকা পরিশোধ করেনি বলে জানা গেছে।
গত ১৮ মে সোনারগাঁও হোটেলকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে শুল্কসহ ভ্যাটের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে পৃথক দুটি চিঠি দেয় এনবিআরের এলটিইউ’র কমিশনার। একইভাবে গত ৭ জুন সাত কর্মদিবসের মধ্যে বকেয়া ভ্যাট সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে টাকা পরিশোধের সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে হোটেল দুটিকে।
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর দেওয়া প্রথম চিঠিতে বলা হয়, ‘সোনারগাঁও হোটেল কর্তৃপক্ষের দায়েরকৃত রিট পিটিশন ও সিভিল রিভিউ পিটিশন (রিট পিটিশন নং- ৫৪৩০/২০০৯ , সিভিল রিভিউ পিটিশন নং- ৫৩৭/২০১৭) মামলার রায় সরকারের পক্ষে প্রচারিত হয়েছে। যা সেনা হোটেল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানের সিভিল রিভিউ পিটিশন (পিটিশন নং- ৪৯৮/২০১৭) মামলার সঙ্গে একত্রে সোনারগাঁও হোটেলের সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশনে দায়েরকৃত সিভিল রিভিউ পিটিশনের রায়ে মামলাটি বরখাস্ত হয়েছে। সুতরাং আদালতের প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী ২০০৫ সালের জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্কসহ মুসক বাবদ ১০ কোটি ৩৬ হাজার ১৮৪ টাকা বর্তমানে নিরঙ্কুশ বকেয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, উক্ত সরকারি বকেয়া পাওনা আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দানপূর্বক ট্রেজারি চালানের মূল কপি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের মূল্য সংযোজন কর বিভাগে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হলো।'
প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওকে দেওয়া অপর এক চিঠিতে বলা হয়, ‘প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সম্পূরক শুল্কসহ মূসকবাবদ ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৬ টাকা অপরিশোধিত বা বকেয়া রয়েছে। অপরিশোধিত ওই টাকা সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে এলটিইউ-এর দাবিনামা চ্যালেঞ্জ করে ২০১১ সালে হোটেল কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করে (রিট পিটিশন নং- ৮০৫১/২০১১)। ওই আদেশ সরকারের পক্ষে গেলে সোনারগাঁও হোটেল থেকে ২০১৭ সালে রিভিউ পিটিশন (সিভিল রিভিউ পিটিশন নং- ৫৩৮/১৭) করা হলে তার রায়ও সরকারের পক্ষে প্রচারিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশন মামলাটি বরখাস্ত হিসেবে রায় প্রদান করেন। ফলে আদালতের প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী ওই দুই বছরের অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্কসহ মূসক ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৬ টাকা বর্তমানে নিরঙ্কুশ বকেয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বকেয়া পাওনা আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে জমাদানপূর্বক ট্রেজারি চালানের মূলকপি এলটিইউ-এর ভ্যাট বিভাগে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হলো।’
ইন্টারকন্টিনেন্টালের পরিচালক (এমডি) বরাবর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ‘রূপসী বাংলা হোটেলের (সাবেক বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড) সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দায়েরকৃত রিট পিটিশন ও সিভিল রিভিউ পিটিশন (রিট পিটিশন নং- ৩৮৮৮/২০০৯, সিপি নং- ১৪২৫/২০১৭, সিভিল রিভিউ পিটিশন নং- ৫৪৪/২০১৭) মামলার রায় সরকারের পক্ষে জারি হয়েছে। অর্থাৎ আপনাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশনে দায়েরকৃত সিভিল রিভিউ পিটিশন মামলাটি বরখাস্ত হয়েছে। সুতরাং আদালতের প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী ২০০৫ সালের জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্কসহ মুসক বাবদ ১৮ কোটি ৮৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৯৪ টাকা বর্তমানে নিরঙ্কুশ বকেয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, উক্ত সরকারি বকেয়া পাওনা আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমাদানপূর্বক ট্রেজারি চালানের মূল কপি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের মূল্য সংযোজন কর বিভাগে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হলো।’
এ বিষয়ে জানতে এলটিইউ-এর ভ্যাট বিভাগের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিভাগের একজন কর্মকতা জানান, অভিজাত হোটেলের বিলাসী পানশালা (মদের বার) ও ড্যান্স ফ্লোরের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কসহ ভ্যাট আদায় করা হয়। সে অুনযায়ী সোনারগাঁও হোটেল ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শুল্কবাবদ ভ্যাট পরিশোধ করেনি এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলও ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভ্যাট পরিশোধ করেনি। পরে এই টাকা আদায় করতে আদালতে মামলা করা হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ মামলায় রিট পিটিশন করে। এতে দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালত এনবিআরের পক্ষ রায় দিয়ে টাকা আদায়ের জন্য নির্দেশ প্রদান করে।
এ বিষয়ে হোটেল সোনারগাঁওয়ের অডিট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হান্নান জানান, অভিজাত হোটেলের ভ্যাট আদায় নিয়ে কিছু সাংঘর্ষিক আইন রয়েছে। এই সমস্যার সুরাহা পাওয়ার জন্য আদালতে আপিল করা হয়েছিল। তবে আদালতে আপিল ডিসমিশড (খারিজ) করেছে। এখন আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী যা করণীয় তাই করা হবে। তবে এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল কর্তৃপক্ষ।
বিভি/এসএইচ/এএইচ/এনএ
মন্তব্য করুন: