বড় সংকটে ১৬ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

ঋণ খেলাপির কারণে বড় সংকটে পড়েছে দেশের ১৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। খেলাপি ঋণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীরা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫০ শতাংশের বেশি রয়েছে খেলাপি ঋণ। যা বিতরণের পর দীর্ঘদিন ধরে এই ঋণ আদায় হচ্ছে না। বর্তমানে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বা ২ শতাংশ। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা ওই সময়ে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আর্থিক খাত কেলেঙ্কারির বড় হোতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, যার জের টানছে পুরো খাত। পি কে হালদারের মালিকানা আছে বা ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। ফলে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ।
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো- বিআইএফসি ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ, বে লিসিং ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্স ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ, এফএএস ফাইন্যান্স ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্স ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, হজ্জ ফাইন্যান্স ৫৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, আইআইডিএফসি ৫৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স ৫৯ দশমিক ১৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, পিপলস লিজিং ৯৯ দশমিক ০২ শতাংশ, ফনিক্স ফাইন্যান্স ৫৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিং ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ৫০ দশমিক ৮২ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভুঁইয়া বলেন, ‘কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি করোনার কারণে প্রায় দুই বছর ঋণ পরিশোধের সময় পিছিয়ে দেওয়ায় ঋণগ্রহীতাদের অনেকেরই কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। এখন ওইসব গ্রাহকের অনেকেই খেলাপি হয়ে পড়ছেন। এ কারণে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই মার্চ, জুন ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বাড়তির দিকে থাকে। বছর শেষে গিয়ে তা কিছুটা কমে। কারণ, বছর শেষে নানা ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি ছিল ৭২ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে গত জুন শেষে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ৬৫৬ কোটি টাকা। তিন মাস আগে মার্চে মোট ঋণ ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ওই তিন মাসে ঋণ বেড়েছিল ৮৮৫ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা, যা গত জুনে বেড়ে হয় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে আরও বেড়ে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি ১৫ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। সেই হিসাবে ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএলএফসিএর সাবেক চেয়ারম্যান ও আইপিডিসির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো অর্থনীতিতে একটি চ্যালেঞ্জ তো আছেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনগুলোর জন্য যেসব নীতিমালা জারি করেছে সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে কঠিন। এর ফলে তাৎক্ষণিক কিছু সমস্যা হলেও দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন খারাপ ও ভালো প্রতিষ্ঠান চিনতে শিখেছে সাধারণ গ্রাহক। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে মানুষ কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেই বিশ্বাস করছিল না। এখন অবিশ্বাস কেটে গেছে। গ্রাহক আরও সচেতন হয়েছে। এখন অনেক ব্যাংকও গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যায়। তাই যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ভালো তারা ভালো করছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্ভাব্য নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একাধিক প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করা হতে পারে তবে একটা ভালো প্রতিষ্ঠান অনিয়মের দায় কাঁধে নিতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান কোনো আইনেও মার্জ করার বিধান নেই। তবে আমার মনে হয় খারাপগুলোকে একটা অপরটার সঙ্গে একত্রিত করতে পারে।’
বিভি/এইচএস
মন্তব্য করুন: