হাই-টেক প্রযুক্তি ও জ্বালানি রূপান্তরে চাকরি হারানোর শঙ্কায় হাজারো পোশাকশ্রমিক

উন্নত প্রযুক্তির হাত ধরে দ্রুত রূপান্তর ঘটছে দেশের তৈরি পোশাকখাতে। বিশেষ করে রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর নতুন বিপ্লব ঘটেছে পোশাক কারখানাগুলোতে। এর রেশ ধরে দ্রুত হারে গড়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল অনুমোদিত বিশ্ব স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানা। বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে পোশাক কারখানার বিভিন্ন স্তরে যুক্ত হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির হাই-টেক প্রযুক্তি। তবে, প্রযুক্তি বিপ্লবের ভিড়ে দেখা দিয়েছে অদৃশ্য এক সংকট। দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হারানোর আশঙ্কায় আছেন হাজারো পোশাক শ্রমিক।
বাংলাদেশে গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল-ইউএসজিবিসি স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠার শুরুটা ২০১১ সালে। সেই বছর ২টি কারখানা লিড স্বীকৃতি পায়। সাভারে রানা প্লাজায় স্মরণকালের ভয়াবহ ট্রাজেডিতে ১ হাজার ১৩৮ জনের নির্মম প্রাণহানি এবং দুই হাজারের বেশি মানুষ আহতের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তৈরি পোশাক খাতের দুর্দশার চিত্র। এরপরই নড়েচড়ে বসেন বিদেশি বায়াররা।
বিদেশি ক্রেতাদের ইশারায় দেশে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স নামে বায়ারদের দু’টি জোটের তাগিদে দেশে কারখানার উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে মনোযোগ দেন বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিকরা। সেই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ বছরে দেশে গড়ে উঠেছে ২৪০টি সবুজ কারখানা। এরমধ্যে সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন প্লাটিনাম ক্যাটাগরির ৯৮টি, গোল্ড ক্যাটাগরির ১২৮টি, সিলভার ক্যাটাগরির ১০টি এবং বাকি চারটি সাধারণ ক্যাটাগরির গ্রিন ফ্যাক্টরি। সবুজ কারখানায় রূপান্তরের অপেক্ষায় আছে আরও পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানা।
পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার ভিড়ে দক্ষ পোশাক শ্রমিকদের চাহিদা বেড়েছে বেশ খানিকটা। তবে, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে কোনো কোনো স্তরে শ্রমিকের সংখ্যাও এখন কম লাগছে। বিশেষ করে রোবটিক তথা অটোমেটেড-স্বয়ংক্রিয় মেশিনারিজ ব্যবহারের কারণে আগে যেখানে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, সেসব জায়গায় এখন শ্রমিক লাগছে ৫ জনের কম। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পোস্টগুলোতেও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সে ধরনের প্রশিক্ষণ না থাকায় ঝরে পড়ছেন অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শ্রমিক।
ঝরে পড়া শ্রমিদের কেউ কেউ পুরোনো ধাঁচের কারখানায় যোগ দিলেও পেশা বদলে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। অন্যদিকে, কারখানাগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যাও কম লাগছে। সেখানেও চাকরি হারানোর শঙ্কা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বিষয়টি স্বীকার করছেন শিল্প মালিকরাও। তবে, এ বিষয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছেন না তারা।
জ্বালানি ও প্রযুক্তির রূপান্তরের শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বাংলাভিশনকে জানান, পরিবেশ ও জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে লোকবল কম লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। এখন প্রয়োজনের তাগিদেই শ্রমিকদের উচিত নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো। এ বিষয়ে কারখানা মালিকরাও প্রশিক্ষণ এবং সিনিয়র-জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এরপরও যারা নিজেদের সময়োপোযোগী করে গড়ে তুলতে পারবে না তাদের ব্যাপারে কিছু করার নেই। এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। কোথায় কোন সেক্টরে শ্রমিকের চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কা রয়েছে সে বিষয়ে গবেষণার তাগিদ দেন তিনি। সেইসাথে দক্ষ খাত থেকে ঝরে পড়া কম দক্ষ শ্রমিকরা যেন অন্য খাতে কাজের সুযোগ পায় সেজন্য পোশাক খাত সম্প্রসারণে সরকারকে এগিয়ে আসার পরামর্শও দেন মহিউদ্দিন রুবেল।
শ্রম অধিকার বিশেষজ্ঞ এবং শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতায় বায়ারদের শর্ত পূরণ করতে হলে জ্বালানি রূপান্তর লাগবেই। এটা শুধু বায়ারদের তাগিদের জন্য নয়, এটা পোশাক কারখানার অস্তিত্বের জন্যও জরুরি। তবে, প্রযুক্তি ও জ্বালানি রূপান্তরটা যেন ন্যায্য হয় সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, যেকোনো রূপান্তর হলে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমিকরা। বাংলাদেশের কাঠামোটাই এমন। এ অবস্থায় রূপান্তরের ফলে কারা অন্যায়-অবিচারের স্বীকার হতে যাচ্ছে তাদের বিষয়টি মানবিকভাবে দেখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে রূপান্তরের ফলে কেউ যেন চাকরি না হারায়। রূপান্তর প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে শ্রমিকদের যেন বাদ দেয়া না হয়। এ বিষয়ে শ্রমিকদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ জরুরি। কেউ কর্মহীন হয়ে পড়লে তার যেন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায় কিংবা বিকল্প কাজের ব্যবস্থা থাকে সেটা নিশ্চিতের উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অগ্রগতির আড়ালে যে অদৃশ্য সংকট দেখা দিয়েছে তাতে শ্রমিকদের সচেতন ও প্রশিক্ষিত করতে না পারলে এর সুফল শুধু কারখানা মালিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। রূপান্তরের ফলে কারখানায় আরামদায়ক পরিবেশ বা উৎপাদনশীলতা বাড়বে ঠিকই কিন্তু এর আড়ালে ঝরে পড়বে হাজারো শ্রমিক। এ বিষয়টি বিবেচনায় মানবিক ন্যায্যতা কতটা নিশ্চিত হচ্ছে—তা নিয়ে এখনই ভাবার উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা।
মো. শামসুদ্দোহা জানান, ‘যখন কার্বন ফুটপ্রিন্টের কথা উঠবে, বায়াররা যখন কম কার্বনযুক্ত কারখানার পোশাক নিতে আগ্রহ দেখাবেন, তখন অনেক মালিকই কমপ্লায়েন্স মেইনটেন করতে চাইবেন না। তখন কোনো কোনো মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নেবেন কিংবা সংকোচন করতে চাইবেন। আর তখনই চাকরি হারাতে পারেন বহু শ্রমিক। এই যে চ্যালেঞ্জগুলো দিন দিন প্রকট হবে সে বিষয়গুলো শ্রমিকদের সাথে নিবিড়ভাবে আলোচনা করা উচিত। তাদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে যেন কাউকে চাকরি হারাতে না হয়।
পোশাকখাতের বিশ্লেষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, জ্বালানির রূপান্তরের ফলে কোথায় কোথায় চাকরি হারানোর শঙ্কা প্রবল হবে সে বিষয়ে একটা বিশ্লেষণ দরকার, গবেষণা দরকার। সেইসাথে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে একটা জাতীয় গাইডলাইন তৈরির তাগিদ দেন গবেষকরা।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: