‘প্রতিশ্রুত সময়ে নির্বাচন না হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন,বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন প্রতিশ্রুত সময়সীমার মধ্যে না হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। সেইসাথে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। টেকসই বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
আজ (২৬ এপ্রিল) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে রাজধানীর এফডিসিতে বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হলেও প্রাপ্ত প্রতিশ্রম্নতি খুব বেশি নয়। এ সম্মেলনে আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের পর্যায়ে উন্নীত করার আশাবাদ প্রকৃতপক্ষে সম্ভব নয়। তবে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ অব্যাহত থাকলে সে সময়ের মধ্যে আমরা থাইল্যান্ডের কাছাকাছি যেতে পারি। বিগত সরকারের আমলে বিনিয়োগ পরিসংখ্যানে অনেক অবাস্তব চিত্র দেওয়া হয়েছিলো।
ড. মুস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ৩৩ বিলিয়ন ডলার আসার কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে এসেছে ১১ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের বর্তমান এফডিআই স্থিতি ৩৬০ বিলিয়ন ডলার হলেও বাংলাদেশে মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার। ভারত—পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগে জন্য উদ্বেগজনক। যুদ্ধ অবস্থায় চলে গেলে ভারতের সামরিক ব্যয় বেড়ে যাবে, ফলে ভারতের সাথে আমাদের শুল্ক সুবিধা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সাম্প্রতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে বিদেশি উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে সরকার বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় ভাবমূর্তি উপস্থাপন করেছে। সম্মেলনে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের মতো করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলেও বাংলাদেশকে মিথ্য ও বানোয়াট তথ্যের মাধ্যমে থাইল্যান্ড—সিঙ্গাপুরের মতো নান্দনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করার গল্প শুনানো হতো। যা ছিলো অবাস্তব। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনেও একই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ১০ বছরে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের অবস্থানে নিতে হলে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে ৩৩ শতাংশ।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ। আমাদের ভাবতে হবে বিনিয়োগ প্রতিশ্রম্নতি ও গ্রাউন্ড রিয়েলিটি এক নয়। বিনিয়োগ সম্মেলনে অনেক প্রতিশ্রম্নতি আসে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবে প্রতিশ্রম্নতি মোতাবেক বিনিয়োগ আসে না। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে বিনিয়োগকারীদের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাংলাদেশে যখন বিনিয়োগ সম্মেলন চলছিল তখন গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের মধ্যে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে ভুল বার্তা দেয়। দেশে বিনিয়োগের কঠিন মন্দা চলছে। উচ্চ সুদের হার, বিদ্যুৎ—গ্যাস—জ্বালানি সংকট ও উচ্চমূল্য, ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন, তারল্য সংকট, কর নীতির দুর্বলতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আইন—শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব কালচার, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকা অথবা বিদেশে পালিয়ে যাওয়া, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে বিদেশি বিনিয়াগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিনিয়োগকারীরা পঁুজি এবং মুনাফা সম্মানের সাথে ফেরতের নিশ্চয়তা চায়। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে লাভ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। রিটার্ন অন অ্যাসেটে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের চেয়েও কম।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী সরকারের পতনের পর ৯৫ টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ৬১৮৮১ জন শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। মানুষের আয় না বাড়ায় অতিদরিদ্রের হার বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে এবছর বাংলাদেশে নতুন করে আরো ৩০ লক্ষ মানুষ অতিদরিদ্র হবার ঝুঁকিতে রয়েছে। দারিদে্র্যর হার ৭.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৩ শতাংশ পেঁৗছাতে পারে। যা দেশের আর্থিক সক্ষমতা তৈরিতে বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করতে হবে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র চেয়াম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন— ১. বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিশ্বাসযোগ্যতা, নীতি ধারাবাহিকতা বিনিয়োগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারী তার বিনিয়োগের পুঁজি ও মুনাফা ফেরত নিতে কোন শঙ্কা না থাকে। ২. শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, লাইসেন্স প্রাপ্তি সহজিকরণ, ন্যায্য দামে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও বিনিয়োগ সেবা নিশ্চিত করে ঙহব ঝঃড়ঢ় ঝবৎারপব সেবা দেওয়াসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা। ৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। ৪. দুনীর্তি বন্ধের পাশাপাশি ট্যাক্স, শুল্ক ছাড় আকর্ষণীয় করা। ৫. শিক্ষার মান বাড়িয়ে শ্রমবাজারের চাহিদার আলোকে দক্ষ শ্রমিক ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপক তৈরি করা। ৬. যেসব শিল্প বৃহৎ পঁুজি আকর্ষণ করে সেসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ব্র্যান্ডিং জোরদার করা।৭. বিডা, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থমন্ত্রণালয় সম্মিলিত ভাবে কাজ করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। ৮. বাণিজ্য কূটনীতিতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব প্রদান করা। ৯. নতুন নতুন বাজার এবং নতুন নতুন পণ্য রপ্তানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। ১০. বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান এর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাত রাজ্যের সমুদ্রের প্রবেশের সুযোগ তৈরি করা। তা হলে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে “সাম্প্রতিক বিনিয়োগ সম্মেলন বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে” শীর্ষক ছায়া সংসদে ঢাকা কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে ইডেন মহিলা কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক মাঈনুল আলম, সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা ও সাংবাদিক জাকির হোসেন। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
বিভি এ/আই
মন্তব্য করুন: