দলীয় নেতার পরিচয়ে ব্যাংকের মধ্যে রাজনৈতিক কার্যালয়!

নূরে আলম সিদ্দিকী ও কামাল হোসেন
কুমিল্লা শহরের বেসরকারি যমুনা ব্যাংকের কান্দিরপাড় শাখার একটি কক্ষ রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে খোদ ব্যাংকের ম্যানেজার ও রাজনৈতিক পরিচয়দানকারী একজন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বিশেষ সুবিধা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এ কাজ করে আসছেন বলে অভিযোগ ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাধারণ গ্রাহকদের।
জানা গেছে, শাখাটির ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকীর পাশের রুমটি মূলত স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কামাল হোসেন দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন। লেনদেন চলাকালিন সময়েও ওই রুমটিতে চলতো নানা রাজনৈতিক কার্যক্রম। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপকও দীর্ঘসময় ধরে এসব কার্যক্রমে অংশ নিতেন। এতে ব্যাংকটিতে আসা গ্রাহকরা লেনদেনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বলেও অভিযোগ করেন সেবা প্রার্থীরা।
আরও পড়ুন:
- টিটি কলেজ-ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, পুলিশ মোতায়েন
- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জে বিএনপির প্রতীকী অনশন
অভিযোগ আছে, একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) পরিচয় দেওয়া স্থানীয় মনোহরগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের নেতা কামাল হোসেন যমুনা ব্যাংকের কান্দিরপাড় শাখাতে শুধু রাজনৈতিক কার্যালয় খুলেই ক্ষ্যান্ত হননি, ব্যাংকটিতে তিনি ব্যবস্থাপক নুরে আলম সিদ্দিকীর জোগসাজসে অনৈতিকভাবে লেনদেনও করে থাকেন। যেখানে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকীও আর্থিকভাবে লাভবান হতেন।
এছাড়া ব্যাংকের মধ্যে দখল করা কক্ষটিতে প্রতিনিয়ত পুরো কুমিল্লার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার ভাগাভাগি হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আনাগোনা ও সরব উপস্থিতি থাকে। নির্মাণাধীন বহুতল ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বর্তমানে যমুনা ব্যাংকের শাখা পরিচালিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যমুনা ব্যাংকের কান্দিরপাড় শাখায় এসব অস্বাভাবিক কার্যক্রম এবং নিয়মিত আড্ডা, রাজনৈতিক লোকজনের আনাগোনা, বিভিন্ন লেনদেনের জন্য ব্যাংকের শাখা অফিসটি কুমিল্লায় বেশ পরিচিত। এছাড়া কান্দিরপাড় শাখার ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকী যমুনা ব্যাংকে যোগদান করার পর তার নামে খোদ যমুনা ব্যাংকেই ৩৭টি ব্যাংক হিসাব এবং কামাল হোসেনের নামে ৩৬টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপকের এবং তার ব্যবসায়িক বন্ধু কামাল হোসেনের এতোগুলো ব্যাংক হিসাব থাকাটা ব্যাংকিং আইনে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, নূরে আলম সিদ্দিকী ও কামাল হোসেনের বিভিন্ন ব্যাংকে ১০০টির অধিক ব্যাংক হিসাব রয়েছে। অভিযোগ আছে, এসব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ইপিজি টেন্ডার বাণিজ্য ও নানা ভাবে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অপচেষ্টা করে আসছে নূরে আলম সিদ্দিকী।
সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের সরকারি টাকা যেমন ইপিজি টেন্ডার এর পে অর্ডার, বিভিন্ন ধরনের ভাতা, উৎসব বোনাস ও ব্যাংকের বিভিন্ন হেডের মাধ্যমে সরকারি ফান্ড আত্মসাৎ করে তা নিজের নামে আনার জন্য এতোগুলো ব্যাংক হিসাব খুলেছেন নূরে আলম সিদ্দিকী। এছাড়া তিনি ব্যাংকে বিভিন্ন প্রবাসী গ্রাহক ও স্থানীয় গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে তাদের বিনা অনুমতিতে অর্থ উত্তোলন করে শেয়ার ব্যবসা, বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসা ও নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন বলেও দাবি স্থানীয়দের। মূলত নূরে আলম সিদ্দিকীর বাড়ি কুমিল্লায় হওয়ায় তিনি এসব অপকর্ম করে আসছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা।
উল্লেখ্য, এর আগে যমুনা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক নিজের নামে ও বিভিন্ন নামে হিসাব খুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ক্লিয়ারিং করে নিজের ব্যাংক হিসাবে এনে অর্থ আত্মসাৎ করেন। যার অভিযোগের ভিত্তিতে বর্তমানে দুদকে মামলা চলমান রয়েছে।
একই ধরনের অভিযোগ খোদ কুমিল্লা কান্দিরপাড় শাখার ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে। শাখার ভেতরে ব্যবসায়ী পরিচয় দেওয়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিয়ে মাদক সেবন ও গ্রাহকের অনুমতি ছাড়াই অ্যাকাউন্টের টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলারও অভিযোগ উঠেছে। তবে কোনো এক অদৃশ্য ক্ষমতার বলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না যমুনা ব্যাংকের হেড অফিস।
ক্ষমতার দাপট দেখানো যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকী ও তার বিশেষ বন্ধু কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ব্যাংক একাউন্ট থাকা এবং অস্বাভাবিক লেনদেন হওয়ায় তা নিয়ে বিভিন্ন সরকারি দফতর অনুসন্ধান চালাচ্ছে বলেও একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বাংলাভিশনকে বলেন, কোনো ব্যাংক সরাসরি তাদের শাখার ভিতরে এই ধরনের কোনো অফিস চালানো ব্যাংক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। যদি গ্রাহকের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিক অন্য অফিস ভাড়া দিতে পারেন। তবে সেটা অবশ্যই শাখার বাইরে হতে হবে। অন্যত্থায় উক্ত শাখার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে শাখা ব্যবস্থাপকের যোগসাজসে ব্যাংকের রুম দখল করে কার্যালয় বানানোর বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দেননি কামাল হোসেন। তিনি দাবি করেন, যেহেতু তিনি ঠিকাদারি কাজ করে থাকেন এবং যমুনা ব্যাংকের কান্দিরপাড় শাখায় লেনদেন করেন তাই প্রায়দিনই তাকে ওই ব্যাংকে যেতে হয়। নিজের কাজের সুবিধার্থে তিনি ওই রুমটি ব্যবহার করেন। তবে তিনি একাই নন রুমটি অন্যান্য গ্রাহকরাও ব্যবহার করেন বলেও দাবি করেন কামাল।
কামাল পাল্টা অভিযোগ করেন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কেউ এমন অভিযোগ করে থাকতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপক নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে অবৈধ লেনদেন ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়টিও এড়িয়ে যান কামাল হোসেন।
এবিষয়টি নিয়ে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মির্জা ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ-এর মুঠোফোন নাম্বারে কল দিয়ে ও এসএমএস পাঠিয়েও তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিভি/এইচএস
মন্তব্য করুন: