অনলাইন বিজনেস প্রতারণায় একমাসে কোটিপতি মোস্তাফিজ

ডিজিটাল মার্কেটিং বিডি নামে দৈনিক ছয়শ টাকা থেকে মাসে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা আয়ের ফাঁদ পেতে কৌশলে একমাসের মধ্যেই কোটি টাকা হাতি নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। এই চক্রের অন্যতম হোতা ময়মনসিংহের মোস্তাফিজুর রহমান। ইতোপূর্বে সে ব্রাইট ফিউচার-২০০ নামে এমন আরেকটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি খুলে সারাদেশ থেকে এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রথমে গ্রাহক টার্গেট করে নামমাত্র টাকার বিনিয়োগে অধিক মুনাফা দিয়ে প্রলুব্ধ করতো তারা। এভাবে কিছুদিন নির্ধারিত গ্রাহকদের মুনাফা দিয়ে সেসব গ্রাহকের মাধ্যমে তাদের পরিচিত স্বজনদের এই কোম্পানিতে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করতো। এভাবে প্রায় ৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়ে কোম্পানি বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যায় মূলহোতারা।
গ্রাহকরা জানান, মোবাইল ফোনের টেলিগ্রাম অ্যাপস ব্যবহার করে এভাবে প্রতারণা জাল ছড়িয়ে রেখেছে প্রায় শতাধিক গ্রুপ। এদের কোনো রিকোয়েস্ট না পাঠালেও তারা ডাটা কালেক্ট করে শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ম্যাসেজ পাঠায়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইলে এসএমএস ও লোভনীয় অফারের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে এসব ক্ষেত্রে তারা ভুয়া রেফারেন্স ব্যবহার করে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের লোকের মাধ্যমেও রেফারেন্স সাপোর্ট দিয়ে থাকে। এরপর ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে সেখানে ডেইলি ট্রাস্ক লিংক পাঠানো হয়।
সেখানে বিভিন্ন ইউটিউব লিংকে সাবস্ক্রাইব করার মাধ্যমে অন্যগ্রুপকে পাঁচ হাজার সাবস্ক্রাইবার সংগ্রহ করে দেয়। যার মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা আয় করে সংশ্লিষ্ট প্রতারক চক্র। সেই টাকাও ওই প্রতারকদের অ্যাকাউন্টে চলে যায়। আর এই পক্রিয়ায় ৫০০ টাকার একজন গ্রাহক মাসিক ২৫ টাকা থেকে শুরু করে। এরপর বিনিয়োগ যত বাড়ে মুনাফার পরিমাণ সেই হিসাবে বাড়ে। এক পর্যায়ে একজন বিনিয়োগকারী দৈনিক প্রায় ৬০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৯ লাখ টাকা আয়ের সুযোগ দেওয়ার লোভনীয় অফার দেয় চক্রটি। প্রতিটি প্যাকেজের মেয়াদ দেওয়া হয় ৩০ দিন করে। ওই টাকার বিলি বন্টনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে (টিম লিডার) লিডার বলে। মূলত সাবস্ক্রাইব লিংকে ক্লিকের মাধ্যমে অর্জিত কমিশনের টাকা এই লিডার বন্টন করেন। সেখানে তাদেরকেও দেওয়া হয় ৫ শতাংশ কমিশন। এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয় এইচএসসি শিক্ষার্থীদের।
কমিশন থেকে অর্জিত টাকার ১০ শতাংশ ট্যাক্সও সয়ংক্রীয়ভাবে কেটে রাখা হয়। এভাবে এজেন্টের মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহ করে ৫০০ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে মাসে ৬শ টাকা ৯ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের লোভ দেখায় প্রতারকরা।
জানা গেছে, ডায়মন্ড, ভিআইপি, গোল্ড এবং মিনি মেম্বার। এই চার ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগকারী সংগ্রহ করে ডিজিটাল মার্কেট বিডি। এদের মধ্যে ডায়মন্ড ৫ লাখ, ভিআইপি ১ লাখ, গোল্ড ৫০ হাজার এরপর বিভিন্ন পদবি দিয়ে ৫০০ টাকায় সদস্যপদ নেওয়ার পর বলা হয় মিনি ক্লায়ান্ট।
এই চক্রের খপ্পরে পড়া রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের দুজন শিক্ষার্থী বাংলাভিশনকে জানান, শুরুতে আমরা টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাদের গ্রুপের লিংক পাই। এরপর তারাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার অনুরোধ করে। যেখানে মোস্তাফিজুর রহমান নিজেই গ্রুপের সদস্যদের সব নিয়মকানুন শেখান। সেই অনুসারে আমরা কাজ শুরু করি। আমরা ৫০ হাজার টাকার একটি আইডিতে তিনদিন কাজ করার পর ৭৫০০ টাকা পেয়েছি। কিন্তু এরপর থেকে আমরা আর কোনো টাকা পাইনি। তাদের এমন প্রলোভনে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি শিক্ষিত স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ-তরুণী বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু টাকা হারিয়ে অনেকেই সর্বশান্ত হয়েছে। অধিকাংশেই শিক্ষার্থী হওয়া লজ্জায় ও পরিবারের ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। আবার এমন অনেকে নিজেরাই এখন এমন অপরাধে জড়ানোর দিকে ঝুঁকছে।
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা আরও বলেন, ‘সারাদেশে মোস্তাফিজের প্রায় ১৪ জন এজেন্ট রয়েছে। তারাই নতুন নতুন গ্রাহক নিয়োগ দেয়। তাদের কেউ কেউ এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী।
ইতোপূর্বে সে ২০২১ সালের ২১ আগস্ট ব্রাইট ফিউচার-২০০ নামেও একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং উদ্বোধন করে। যার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি রয়েছে। সেখানে দেখা যায় তিনি ফুল দিয়ে কয়েকজন কর্মীকে বরণ করে নিচ্ছেন।
প্রতারণার শিকার শিক্ষার্থীরা টাকা ফেরত চাইলে ডিজিটাল মার্কেটের বিডি’র মোস্তাফিজ বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেন বলেন, ‘গ্রামে ফলের বাগান করেছি। প্রয়োজনে বাবার জমি বিক্রি করে হলেও আপনাদের টাকা আমি পরিশোধ করবো।’
ডিজিটাল মার্কেটিং বিডি’র রংপুর বিভাগের অ্যাজেন্ট (টিম লিডার) এইচএসসি পরীক্ষার্থী ফরহান সরকার বাংলাভিশনকে জানান, গত ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে মোস্তাফিজ আর আমার ফোন ধরে না। ওইদিন আমরা একটি অনলাইন কনফারেন্সে যুক্ত হয়েছিলাম। তখন আমি টাকা ফেরত চাইলে মোস্তাফিজ ১৫ দিনের সময় চেয়েছে। এরপর গ্রাহকরা আমাকে টাকার জন্য চাপ দিলে আমি মোস্তাফিজকে ফোন দেই কিন্তু সে ফোন ধরে না। ওয়েবসাইটও বন্ধ। তাই কোনোভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। এমনকি অন্য টিম লিডারদেরও মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি।’
গ্রাহকপ্রতি আপনি কত কমিশন পেতেন জানতে চাইলে ফরহান সরকার বলেন, ‘আমি গ্রাহকপ্রতি ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কমিশন পেতাম। এক্ষেত্রে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকাও মাসে পেয়েছেন-আমার কাছে এমন তথ্য রয়েছে।’
আপনার কোনো বিনিয়োগ আছে কি-না জানতে চাইলে ফারহান বলেন, ‘আমি ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছি। এছাড়া সাবস্ক্রাইবের কমিশন বাবদ ৪০ হাজার টাকার বেশি গ্রাহকদের দিয়েছিলাম। এখন আমারই প্রায় এক লাখ টাকা আটকে গেছে।’
ডিজিটাল মার্কেটিং বিডি’র অফিস কোথায় জানতে চাইলে রীতিমত আকাশ ভেঙে পড়ার মতো উত্তর দিয়ে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহান সরকার বলেন, ‘বাস্তবে আমাদের কোনো অফিস নেই। এখানে সবকিছু ভার্চ্যুয়াল। তবে আমাদের লিডারের বাড়ি শুনেছি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। সেখানে ইসলামী ব্যাংকে থেকে তিনি টাকা তুলেছেন। এবং সেই ছবি শেয়ারও করেছেন। এখন ওয়েবসাইটই বন্ধ নয়তো ছবি দেখাতে পারতাম।’
বিষয়টি নিয়ে বাংলাভিশনের প্রতিবেদক মোস্তাফিজুর রহমানের নাম্বারে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অভিনব এই প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা শিক্ষার্থীরা এমন প্রতারক চক্র থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারী বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের রক্ষা ও আত্মসাত করা টাকা উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করেন।
বিভি/এসএইচ/এনএ
মন্তব্য করুন: