আইসিইউতে ছাত্র রাজেশ রায়
কি হয়েছিলো সেই রাতে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে

ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী গোপাল রায় রাজেশ
ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী গোপাল রায় রাজেশ (১৮) আহতাবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাধীন। ছয়দিনেও জ্ঞান ফিরেনি তার।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে রাজেশ। তার আহত হওয়ার ঘটনাটি পরিবারের কাছে এখনও রহস্যময়। তাদের ধারনা- রাজেশ নির্যাতনের শিকার। তবে অভিযোগের স্বপক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষী মিলেনি ঘটনার তদন্তে।
গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের প্রণয় রায়ের ছেলে রাজেশ ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কবি আলাওল হলের ৩য় তলায় ৩০৮ নম্বর রুমে থাকতো। ২৩ মে রাত ১১টার দিকে তাকে প্রথমে ফরিদপুরের বিএসএমএমসি হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা
গুরুতর হওয়ায় তাকে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে এখন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সে।
এদিকে রাজেশের বাবা প্রণয় রায় ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় ২৫ মে একটি লিখিত অভিযোগে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য আবেদন জানান পুলিশে।
তিনি বলেন, আমগাছ থেকে পড়ে গেলে রাজেশের হাত-পা ছিলে যাওয়া, পা ভেঙ্গে যাওয়া এবং কোমর বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা। কিন্তু তার শরীরে এই ধরনের কোনো চিহ্ন নেই। বরং মাথা ও কানের পাশে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে; যা দেখে মনে হয় কোন কিছু দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে। একটি হাতের কব্জি এমনভাবে আহত হয়েছে যে, মনে হয় কেউ যেন কব্জি ভেঙ্গে দিয়েছে। চোখ দুটি রক্ত জমে উঁচু হয়ে রয়েছে। গাছ থেকে পড়লে চোখ ফুলে রক্ত জমার কথা নয়। এছাড়া তার শোল্ডার ডিসলোকেশন হয়েছে। একারণে গাছ থেকে পড়ে তার আহত হওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য না।
এ ব্যাপারে রাজেশের সহপাঠী ও সম্পর্কে আত্মীয় আকাশ নামে একই ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী আকাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা দু’জন (রাজেশ ও আকাশ) পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কবি আলাওল হলের ৩য় তলায় পাশাপাশি রুমে থাকেন। ২৩ মে সন্ধার পর রাজেশ তাকে বলে, ‘চল্ হোস্টেলের আম গাছ থেকে আম পাড়ি।’ তবে তার অ্যাসাইনমেন্ট থাকায় সে রাজেশের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিচতলায় অ্যাসাইনমেন্টের কাজে যায়। ‘আমি যখন অ্যাসাইনমেন্টের কাজে নিচে তখনও রাজেশ আমার রুমে একা বেশ কিছুক্ষণ বন্ধুদের সাথে সময় কাটায় বলে জানতে পারি’ জানায় আকাশ।
‘এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমি যখন রুমে বসে পড়াশোনা করছিলাম হঠাৎই একটু হৈ-হট্টগোলের আওয়াজ শুনতে পাই। ছেলেরা দৌড়াদৌড়ি করছিলো। এরপর আমিও বাইরে এসে শুনি রাজেশ আম গাছ থেকে পড়ে গেছে।’ ঘটনা সম্মন্ধে আকাশের সরল স্বীকারোক্তি এটি।
এই ঘটনা তদন্তে কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্র হোস্টেলের সুপার রিয়াজ হোসেনকে প্রধান করে শিক্ষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন অধিকারী ও সিকিউরিটি অফিসারসহ পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, পরের দিন ২৪ মে সকালে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে রোভার অ্যাসেম্বলি হওয়ার কথা ছিলো। এজন্য সেখানে রোভারের ছাত্ররা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করছিলো। যার পাশেই ওই আম গাছটি অবস্থিত। এছাড়া রাজেশ যখন আম গাছে তখন তার তিনজন সঙ্গী ওই আম গাছের নিচে অবস্থান করছিলো।
এমন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকার পরেও কেন ঘটনাটি নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে রাজেশের পরিবারে? এই প্রশ্নের জবাবে জানা যায়, ঘটনার পরপরই রাজেশের সহপাঠী এবং তার গ্রামের পাশের গ্রামের এক ছেলে তার বাবা প্রণয় রায়কে ফোন করে জানায় যে, রাজেশ সিড়ি থেকে পড়ে আহত হয়েছে। ছেলের অসুস্থতা নিয়ে দুই ধরণের বক্তব্য পাওয়ায় তার পরিবার বিভ্রান্তিতে পড়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ মে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়। তার দুই একদিন আগে তারা হোস্টেলে উঠে। এরপর মাত্র ক’দিনের মধ্যে হোস্টেলে র্যাগিংয়ে রাজেশের আহত হওয়ার অভিযোগ তাদের কাছে উদ্ভট লাগছে।
ঘটনার পরেরদিন সকালে কোতোয়ালি থানার একজন এসআই ঘটনাস্থলে যান বিষয়টি তদন্তে। ওইদিন বিকালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও তদন্ত) মোহাম্মদ ইমদাদ হোসাইন ও থানার ওসি এমএ জলিল ঘটনা তদন্তে যান। তারাও এব্যাপারে পরিবারের অভিযোগের সমর্থনে কিছু জানাতে পারেননি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও তদন্ত) মোহাম্মদ ইমদাদ হোসাইন বলেন, সরেজমিনে তারা ঘটনাটি তদন্ত করেছেন। সবার সাথে কথাবার্তা বলে এবং ব্যাপক খোঁজখবর নিয়ে তারা জানতে পেরেছেন এটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা। তবে রাজেশের জ্ঞান ফেরার পর তার বক্তব্য জানা গেলে আসল বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে।
ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী শেখ বলেন, গত বৃহস্পতিবার কয়েকজন অভিভাবক এব্যাপারে কিছু বক্তব্য দেন। এরপর তাদের এসব বক্তব্য খুটিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটিকে আরও দুই একদিন সময় দেওয়া হয়। কাল- পরশুর মধ্যে তারা প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে তিনি জানান। ঘটনাটি খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর সাথে শুধু এই কলেজই নয়, ফরিদপুরেরও ভাবমূর্তি জড়িত।
বিভি/এএন
মন্তব্য করুন: