আমাদের শবে বরাতের প্রার্থনায় একাত্তরের এই শহীদ থাকবেন তো?

শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনা
আজ উদযাপিত হচ্ছে পবিত্র শবে বরাত। একাত্তর সালে শবে বরাত পালিত হয়েছিল ৫ অক্টোবর মঙ্গলবার। ৫১ বছর আগের এইদিনে শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনাকে তাঁর আড়াই বছর বয়সী শিশুসহ ধরে আনে মাগুরার মহম্মদপুর থানার কোন এক গ্রাম থেকে। যেখানে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
'শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনা' ধৃত হয়েছিলেন বাঙালি 'অমানুষ' রাজাকারদের হাতে। এরপর এদিনই তাঁকে মাগুরা শহরে এনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয় ওরা।
পবিত্র শবে বরাতের রাতে, তারা হেলেনের শিশু পুত্র দিলীরের কান্না উপেক্ষা করে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে পাঠিয়ে দেয় নানার বাড়িতে। এরপর সে রাতেই, পাকিস্তানী হানাদাররা অমানবিক ও নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে তাঁকে।
হত্যার পর পাকিস্তানী সেনারা তাঁর প্রাণহীন দেহ জিপের পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে যায় শহরের অদূরে নবগঙ্গা নদীর ডাইভারশন ক্যানেলে। সেই ক্যানেলে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ ফেলে দেয়া হয়। শহীদ হেলেনার দেহ আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি মিশে গেলেন তাঁর বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে।
আমাদের শবে বরাতের প্রার্থনায়, একাত্তরের এই শহীদ থাকবেন তো ?
এক নজরে শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনা (হেলেন)
শহীদ লুৎফুন নাহার হেলেনা (২৮ ডিসেম্বর, ১৯৪৭-৫ অক্টোবর, ১৯৭১) শিক্ষিকা, রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক।
ম্যাট্রিক পাস করার পর ১৯৬৫ সালে মাগুরা কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করার পর মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন।
ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি মাগুরা কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নারী বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মাগুরা মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। স্নাতক শেষ করার পর মাগুরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা পদে যোগদান করেন তিনি।
মাগুরা শহরে বসবাস করলেও তাঁর গ্রামের বাড়ি ছিল, মহম্মদপুর থানার হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে তখনকার মাওবাদী সংগঠন ইপিসিপি (এম-এল) গড়ে ওঠা গেরিলা অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে পার্টির দায়িত্ব পালন করতেন হেলেনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে মাগুরার মোহাম্মদপুর থানার একটি রাজাকার ক্যাম্প দখল করে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে রূপান্তর করেন। তাঁর ভাইয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও দায়িত্ব পালনকারী এই মহান বীর মুক্তিবাহিনী গুপ্তচর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে জানা যায়।
রশীদ হায়দার সম্পাদিত 'স্মৃতি ১৯৭১'- এ তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা 'আলী কদর' উল্লেখ করেছেন, "মহম্মদপুর থানার এক গ্রামে অবস্থানকালে রাজাকার ও ঘাতক দালালদের গুপ্তচরের সহায়তায় হেলেন ২ বছর ৫ মাস বয়স্ক শিশু পুত্র দিলীরসহ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে গেলে তাকে তারা সরাসরি নিয়ে আসে মাগুরা শহরে। এরপর পাকিস্থান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে তাকে সোপর্দ করা হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
হেলেনের এই দুঃসংবাদে তার বৃদ্ধ পিতা ও কতিপয় আত্মীয়-স্বজন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা হেলেনের মুক্তির জন্য শত অনুরোধ সত্ত্বেও জামাতপন্থী ঘাতক দালালরা তার মুক্তির ব্যাপারে সব চাইতে বেশি বাঁধা সৃষ্টি করে।
আলোচনায় পাকবাহিনী কর্মকর্তাকে জানায় যে, হেলেন মাগুরার বামপন্থী নেতা মাহফুজুল হকের বোন এবং মহম্মদপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বাহিনী প্রধান বামপন্থী নেতা আলী কদরের স্ত্রী। সুতরাং তার মুক্তির প্রশ্নই ওঠে না।
‘...হেলেনের মৃত্যু হয় ১৯৭১-এর ৫ অক্টোবর রাত্রিবেলায়। ঐ রাত ছিল সকল মুসলমানদের এক পবিত্র রাত শব-ই-বরাত। ঐ রাতেই তারা হেলেনের শিশু পুত্র দিলীরের করুণ-কান্নাকে উপেক্ষা করে তাকে মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাঠিয়ে দেয় নানা বাড়িতে। তারপর অমানবিক নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে হেলেনকে।’
ছবি : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: