আবারও জনপ্রিয় জেলেনস্কির কমেডি সিরিজ, দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন দেশে

সাত বছর আগে একটি কমেডি সিরিজে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। ৩৮ বছরের সেই অভিনেতা যে বাস্তবেও দেশের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে উঠবেন, তা বোধ হয় কল্পনাও করতে পারেননি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
অভিনেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা হয়ে উঠলেও জেলেনস্কির রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। তবে রাশিরায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা এই নেতার সাহসী মনোভাবকে অগ্রাহ্য করতে পারছেন না তাঁর সমালোচকরাও। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে ইউক্রেনকে ‘একা’ই নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৪৪ বছরের জেলেনস্কি।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগে জেলেনস্কি একজন প্রখ্যাত অভিনেতা ও কমেডিয়ান ছিলেন। ২০১৫ সালে ‘সার্ভেন্ট অফ দ্য পিপল’ সিরিজে তিনি স্কুল শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ওই কমেডি সিরিজে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি নিয়ে দেওয়া তাঁর বক্তৃতার একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর একসময় জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। তাঁর এক ছাত্র ভিডিওটি গোপনে ধারণ করে প্রকাশ করেছিলো। সিরিজটি ইউক্রেনে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। বেশ কিছু পুরস্কারও জিতেছিলো সেটি।
২০১৯ সালে যখন জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো তাঁর ইউক্রেনিয়ান ভাষা নিয়ে হাসাহাসি করেছিলেন। কারণ জন্মসূত্রে জেলেনস্কির প্রাথমিক ভাষা হচ্ছে রুশ। এছাড়া পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো রাজনৈতিক মর্যাদা তাঁর নেই বলেও মন্তব্য করেছিলেন পোরোশেঙ্কো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় পোরোশেঙ্কোকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে যান জেলেনস্কি। প্রায় ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর জনপ্রিয়তা বেড়েছে জেলেনস্কির কমেডি সিরিজের
জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর একসময়ের কমেডিয়ান জেলেনস্কি যুদ্ধকালীন নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। বিশ্বব্যাপী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা অনেকখানি বেড়েছে। ফলে তাঁর অভিনীত কমেডি সিরিজের চাহিদাও বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিরিজটি দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
একো রাইটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওই কমেডি সিরিজের ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে আছে। কোম্পানির ম্যানেজিং পার্টনার নিকোলা সাদারলুন্ড জানিয়েছেন, গত কয়েকদিনে সিরিজটির বিক্রি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের এমবিসি, গ্রিসের এএনটি ওয়ান ও রোমানিয়ার প্রো টিভি সিরিজটি দেখানোর অনুমতি পেয়েছে বলে জানিয়েছে একো রাইটস। বুলগেরিয়া, মলদোভা, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও জর্জিয়ার প্রচারমাধ্যমও অনুমতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
সম্প্রতি ইউক্রেনের রেডক্রসকে ৫০ হাজার ইউরো দান করেছে একো রাইটস।
ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর জানিয়েছে, তারা ‘সার্ভেন্ট অফ দ্য পিপল’ সিরিজ প্রচারের অনুমতি পেয়েছে। রবিবার তারা একটি পর্ব প্রচার করবে।
জেলেনেস্কির জন্ম এবং বড় হওয়া
দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের ক্রাইভিই রিহ অঞ্চলে ১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম, ওই অঞ্চলেই বেড়ে ওঠা ভলোদিমির ওলেকজান্দ্রোভিজ জেলেনস্কির। ঘটনাচক্রে, তাঁর বাড়ির আশপাশে রাশিয়াভাষীদের বসতিই বেশি। বাবা ক্রাইভিই রিহ ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক্স-এ সাইবারনেটিক্স এবং কম্পিউটিং হার্ডওয়্যারের অধ্যাপক। মা ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলেনস্কির ঠাকুরদা রেড আর্মির হয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন। এককালে নাৎসি বাহিনীর হাতে ঠাকুরদার পরিবারের অনেকে নিহত হয়েছিলেন।
স্কুলের পড়াশোনার শেষে ভর্তি হতে হয়েছিল ক্রাইভিই রিহ ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক্স-এ। সেখান থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনার পর ডিগ্রি লাভ। তবে আইনজ্ঞ হওয়ার ইচ্ছে ছিলো না জেলেনস্কির। প্রথাগত পড়াশোনার শেষে জেলেনস্কি অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলে একটি কমেডি শোয়ে দল নিয়ে যোগ দেন। ১৯৯৭ সালে জাতীয় স্তরের কমেডি প্রতিযোগিতাও জিতে ফেলেন জেলেনস্কিরা। সে বছরেই ‘কিভারতাল ৯৫’ নামে একটি দল খুলে ফেলেন জেলেনস্কি। ১৯৯৮ থাকে ২০০৩- নিজের দল নিয়ে মস্কোসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একাধিক দেশে শো করতে গিয়েছেন তিনি।
২০০৩ সালে জেলেনস্কির পেশা জীবনে বড় মোড় আসে। সে বছর থেকেই টেলিভিশনের জন্য কমেডি শো তৈরি করতে শুরু করেন জেলেনস্কি। ২০০৮ সালে অভিনেতা জেলেনস্কি টেলিভিশনের পর্দায় থেকে সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। সে বছর ‘লাভ ইন দ্য বিগ সিটি’ দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক করেন জেলেনস্কি। বছর দুয়েক পর এর সিক্যুয়েল এলো ‘লাভ ইন দ্য বিগ সিটি-২’। তাতেও ছিলেন জেলেনস্কি। এরপর ‘অফিস রোম্যান্স’, ‘আওয়ার টাইম’ বা ‘এইট ফার্স্ট ডেটস’-এর মতো ছবিতেও দেখা গিয়েছিলো তাঁকে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন জেলেনস্কি।
কমেডি অভিনেতা থেকে রাষ্ট্রপতির পদে
জনপ্রিয় কমেডি টিভি সিরিজ ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপ্ল’-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন জেলেনস্কি। ইউক্রেন সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় জেলেনস্কির জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। টেলিভিশনে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ওই সিরিজে মেতেছিলেন ইউক্রেনবাসী। কমেডি শোয়ের সেই প্রতিবাদী চরিত্রই একসময় দেশের প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে নাম লেখান। ২০১৮ সালে ‘কিভারতাল ৯৫’ নামেই রাজনৈতিক দল খোলেন জেলেনস্কি।
পরের বছর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছ’মাসের মধ্যেই জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিলো, প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে জেলেনস্কি।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় জেলেনস্কির সমালোচকরা বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যে ধরনের গাম্ভীর্যভাব দরকার, সেটা তাঁর নেই। এর উত্তরে জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সাধারণ মানুষ, যে সিস্টেম ভাঙতে এসেছে।’
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘এতোদিন ইউক্রেনীয়দের হাসানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, আর এখন এমন চেষ্টা করবো যেন ইউক্রেনীয়দের কাঁদতে না হয়।’
চলমান যুদ্ধের মধ্যেই সোমবার (৭ মার্চ) তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। তবে এবারের বৈঠকটি কোথায় হচ্ছে সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
দেশ দুটির মধ্যে প্রথম দুটি বৈঠক হয়েছিলো ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে। তবে তৃতীয় বৈঠক নিয়ে দুই পক্ষ রাজি হলেও স্থান নিয়ে কোন বার্তা এখনো পাওয়া যায়নি।
বিভি/এসডি
মন্তব্য করুন: