আস্থাশীল ইসি

কেএম নূরুল হুদা’র নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিদায়ের পর গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলের আস্থা অর্জনের জন্য কাজ নানান উদ্যোগ নিয়েছে এই কমিশন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, সচিবসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বৈঠকও করেছে কমিশন। কমিশন কাজ করে গেলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে আস্থা-অনাস্থার মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। সম্প্রতি বিএনপি’র সাতজন সংসদ সদস্যের (এমপি) পদত্যাগের মাধ্যমে সেই লড়াইয়ে ডালপালা যোগ হচ্ছে।
এছাড়া ইসির ডাকা সংলাপে যোগ দেয়নি বিএনপি ও সমমনারা। অনাস্থা এনে এই কমিশনের অধিনে কোনো নির্বাচনেও যাচ্ছে দলটি। তবে কমিশনের দাবি এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। কমিশনের ধারাবাহিক কার্যক্রমের ফলে নির্বাচনে ইতিবাচক সাড়া পড়ছে। সাধারণ নির্বাচনেও মানুষ আগ্রহ সহকারে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবেন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। কমিশন এই ব্যাপারে আস্থাশীল হয়ে উঠছে।
২০২২ সালের কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা আসার পর যে আমাদের অধীনে যে নির্বাচনগুলো আয়োজিত হয়েছে। এটা আমি মনে করি আগের তুলনায় সহিংসতা অনেক কম হয়েছে এবং হয়ই নাই। হয়তো একটা শিশু মারা গিয়েছিল বাবার কোলে, সেটা ভোটের পরে। তো সহিংসটা হয়নি, এটা ভাল দিক। আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এই ধারাটা যদি ধরে রাখতে পারি। ইতিবাচক দিক যেটা হবে, সাধারণ নির্বাচনেও মানুষ আগ্রহ সহকারে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবেন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এইটুকু আমরা সেই ব্যাপারে আস্থাশীল হয়ে উঠছি।
২০২২ সালে যা নিয়ে আলোচনায় ছিলো নির্বাচন কমিশন:
নির্বাচন কমিশন আইন ও নতুন কমিশন নিয়োগ:
চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথমবারের মত নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে দেন রাষ্ট্রপতি। সার্চ কমিটির প্রথম বৈঠকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও সুধীজনের কাছ থেকে নাম আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। সরাসরি ও ই-মেইলের মাধ্যমে সার্চ কমিটির কাছে প্রায় ৫০০ জনের নাম জমা পড়ে। ১৪ ফেব্রুয়ারি জমা পড়া নাম থেকে প্রথম দফায় কমন নাম বাদ দিয়ে ৩২২ জনের তালিকা প্রকাশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর সার্চ কমিটি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমেও বেশ কিছু নাম পায়। তালিকায় প্রস্তাবিত নামের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২৯ জনে। একাধিক দফায় বৈঠক করে ২০ জনের নাম বাছাই করা হয়। পরবর্তীতে সেটি ১২-১৩ জনে আসে। ২২ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে গিয়ে সিইসি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য নামগুলো রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে জমা দেয় সার্চ কমিটি।
২৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধান করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান (অব.), সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশেদা সুলতানা, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান।
সংলাপ:
কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নিয়েই রাজনৈতিক দল, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ১৬ দিন ধরে চলা সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এতে বিএনপিসহ সমমনারা এতে অংশ নেয়নি। যারা অংশ নিয়েছে তাদের মধ্য থেকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত আসে।
সংলাপে তলোয়ার-রাইফেল বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক:
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) এর সঙ্গে সংলাপে ববি হাজ্জাজের এক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল মন্তব্য করেন, ‘আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করবো?’ সিইসির এমন বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে বেশ আলোচনা হয়।
রোডম্যাপ:
সংলাপে পর রোডম্যাপও তৈরি করেছে কমিশন। এতে সুষ্ঠু ভোট করতে নানান উদ্যোগ ও কোন সময়ের মধ্যে কোনো কাজ করা হবে তার কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
কুমিল্লা সিটি ভোট:
গত ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন সুষ্ঠু অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট সম্পন্ন হলেও ভোটগণনার সময় ১০১টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর বেশকিছুক্ষণ ফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়। এ নিয়েও আলোচনা হয়।
বাহাউদ্দিন বাহাস:
নির্বাচন সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলাকালে কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে নির্বাচনি এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয় কমিশন। ইসির ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হন বাহাউদ্দিন। পরে অবশ্য সিইসি বলেন, বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়নি, অনুরোধ করেছেন। ভোটার এলাকায় কারো বাড়ি হলে বাড়িতে থাকতে বাধা নেই। বিষয়টি বেশ আলোচনার সৃষ্টি করে।
ইসি আনিছুর রহমানের ক্ষোভ ও ডিসি-এসপিদের হৈ চৈ:
প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ (টিওটি) কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। অনুষ্ঠানে আনিছুর রহমান বলেন, ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক তাকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানান। তাকে কর্মসূচির কাগজ পাঠানো হয়, এতে তিনি দেখতে পান, সেখানে তার নাম নেই। এর কয়েক মিনিট পর মহাপরিচালক ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং আমন্ত্রণপত্রটি সংশোধন করেন। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আনিছুর রহমান।
এছাড়া নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত সকল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ইসি আনিছুর রহমানের বক্তব্যের একপর্যায়ে সভাকক্ষের মধ্যেই একযোগে ডিসি-এসপিরা হইচই শুরু করেন। এই ঘটনার পর বেশ কিছুদিন অফিস করেননি তিনি।
গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচন:
গাইবান্ধা-৫ আসনে ১২ অক্টোবর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এই ঢাকার নির্বাচন ভবনে বসে সিসি ক্যামেরার মধ্যে তা পর্যবেক্ষণ করে কমিশন। ভোট পর্যবেক্ষণকালে অনিয়ম ধরা পড়ায় প্রথমে ৫০টি কেন্দ্র ও পরে নজির স্থাপন করে পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেয় কমিশন। এতে কমিশন বিভিন্ন মহলে বেশ প্রশংসা পায়।
পরে তদন্ত করে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ১৩৩ জন কর্মকর্তা বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন।
নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল:
গত ২ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নির্বাচনি অপরাধ করায় নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে ইসি।এতে বেশ আলোচনার সৃষ্টি হয় এবং কমিশনের প্রশংসা হয়।
আরপিও সংশোধনে মন্ত্রণালয়ের সাড়া না পাওয়া:
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের জন্য পাঠিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে তিনবার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় কমিশন। শেষ চিঠি লেখা হয় এটিই শেষ চিঠি। যদিও এর পরপরই মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় কাজ চলছে।
ইভিএম:
সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও ২ লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প হাতে নেয় কমিশন। যা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্পটি পাস হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় কমিশন।
বছর শেষে রংপুরেও স্বস্তি:
২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনও ঢাকা থেকে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে করে কমিশন। কোনো অপ্রীতির ঘটনা ছাড়াই ভোট সম্পন্ন করতে পারে কমিশন। এর মাধ্যমে স্বস্তিতে বছরটা পাড় করলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
বিভি/এইচকে
মন্তব্য করুন: