গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে মাকে ‘ভালো আছি’ বলা ছেলেটি কেমন আছেন?

গুলিবিদ্ধ দেহ নিয়ে হাসপাতালে অথচ মাকে বলছেন একটু এজমার সমস্যা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় এমন একটি ভিডিও। ভিডিওর সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গুলিবিদ্ধ সেই তরুণের নাম বাকি বিল্লাহ। তিনি রাজধানীর প্রাইম ইউনির্ভাসিটির আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
গত ১৮ জুলাই রাত ৮টার দিকে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় বিজিবির গুলিতে প্রথমে হাতে এবং কোমরে গুলিবিদ্ধ হন বাকি বিল্লাহ। সে সময় তাকে সহপাঠীরা উদ্ধার করে বাড্ডার নাগরিক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু ঢাকায় বাকি বিল্লাহর কোনো আত্মীয় ছিল না। তার বন্ধুরা মোবাইল ঘেটে সবশেষ কল লিস্টে ফারহানা ফাল্গুনী নামের নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টের একজন আইনজীবীর নম্বর পায়। তাকে কল করা হলে তিনি এসে বাকি বিল্লাহকে নিজ বাসায় নিয়ে যান।
আইনজীবী ফারহানা ফাল্গুনী বাকি বিল্লাহকে শুধু আশ্রয়ই দেননি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই আহত ছাত্রের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। শিডিউল অনুযায়ী দ্বিতীয় বার গুলির স্থানে ড্রেসিং করাতে গেলে বাকি বিল্লাহ সরকার বিরোধী আন্দোলনে আহত বলে ঢাকা মেডিকেল তার চিকিৎসা করতে রাজি হয়নি। পরে নিজের পরিচিত চিকিৎসকের মাধ্যমে গোপনে নারায়ণগঞ্জের কেয়ার হাসপাতালে অস্ত্রোপাচারের ব্যবস্থা করেন।
বাকি বিল্লাহ বাংলাভিশনকে বলেন, আমার মা হার্টের রোগী। বাবাও অসুস্থ। তাই প্রথমে আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা তাদের জানাইনি। আমার সহপাঠীরা আমার মোবাইল থেকে নম্বর নিয়ে ফারহানা ফাল্গুনীকে আন্টিকে কল করলে তিনি দ্রুত হাসপাতালে আসেন। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় আমরা যখন দ্বিতীয় দফা ঢাকা মেডিকেলে যাই তখন তারা সাফ জানিয়ে দেয় আমার চিকিৎসা এখানে হবে না। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা চলে আসি পরে তিনি নারায়ণগঞ্জের কেয়ার হাসপাতালে ব্যবস্থা করেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা বেলা ১১টা থেকে বাড্ডার রাস্তায় অবস্থান নেই। প্রথমে আমার সামনে ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এতে আমরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে যাই। আমরা রাস্তা অবরোধ করে রাখি। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ বার বার আমাদের ওপর হামলা করেও আমাদের সরাতে পারেনি। তারপর বিজিবি আসে। তারা অনবরত গুলি করতে থাকে। তখন আমি দেখছিলাম আমার পাশে সব একে একে পড়ে যাচ্ছে। আমার পাশে দশ বছর বয়সী একজন পথশিশুর হাতের বাহুতে গুলি লেগে তার হাটতা ছুটে যায়। সে সেখানেই ছটফট করতে করতে মারা যায়। তখন আমার হাতেও গুলি লাগে। যদিও আমি তাও লড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি দেখলাম আমার পাশের একজনের চোখের ভেতর দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। তখন আমি এক হাতে তাকে কাঁধে তুলে এম্বুলেন্সের দিতে নিতে যাই। এ সময় আমাকে পেছন থেকে গুলি করে। গুলিটা আমার কোমরের মাংসের ভেতর দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি পড়ে গিয়ে চিৎকার করি। সেসময় আমাকে কয়েকজন মিলে হাসপাতালে নিয়ে পাশের নাগরিক যায়।
মায়ের সাথে মিথ্যা বলার প্রসঙ্গে বাকি বিল্লাহ বলেন, আমার মা ও বাবা দুজনই অসুস্থ। আমি গুলিবিদ্ধ শুনলে তারা স্ট্রোক করতো তাই মিথ্যা বলেছি। দশদিন পরে যখন কিছুটা শঙ্কা কেটেছে তখন জানিয়েছি।
নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে সেদিন বিটিভিতে ছাত্ররা আগুন দেয়নি বলেও দাবি করেন এই আহত শিক্ষার্থী।
বাকি বিল্লাহকে আশ্রয় দেওয়া নারাণয়গঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী ফারহানা ফাল্গুনী বলেন, অনেক ঝুঁকি ছিল ঠিক কিন্তু আমি তখন ভেবেছি একটা জীবন বাঁচানো জরুরি। এটা ভাবার কারণে আমার ভয় আর কাজ করেনি। আমি অনেক লুকোচুরি করে তাকে হাসপাতালে আনা নেওয়া করেছি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো- ঢাকা মেডিকেল তাকে চিকিৎসা দেয়নি। তারা বলেছে, সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা চিকিৎসা দিতে পারবেন না। তারা বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিল।
বাকি বিল্লাহ তার কৃষক-কৃষাণী বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড়। তাকে ঘিরে বাবা-মায়ের ছিল অনেক আশা। কিন্তু তার হাত ও পা অক্ষম হয়ে পড়ায় বেশ চিন্তিত তার মোসাম্মৎ পারভীন। তিনি বলেন, ওর বাবার যেহেতু আয় নেই আমার এই ছেলেকে নিয়ে আমরা আশায় ছিলাম। কিন্তু এখনতো সে অক্ষম হয়ে গেল। এখন তার কি হবে, আমরা কীভাবে চলবো একমাত্র আল্লাহ জানেন।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: