ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ফাইল ছবি
দুই দিনের সরকারি সফরে আগামী রবিবার পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। ইসহাক দারের সফরকালে বেশ কয়েকটি চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব বিষয় চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) জানিয়েছেন, ‘কয়টি চুক্তি সই হবে সেটি এখনো নিশ্চিত নয়, তবে একাধিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।’
এই সফরকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যা বিগত ১৩ বছরের মধ্যে কোনো পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দুই দেশের সম্পর্কের অচলাবস্থা নিরসনে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার জন্য এই সফরকে কূটনীতিকরা একটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলে এই ধরণের উচ্চ পর্যায়ের সফর হওয়া অপরিহার্য।’ তিনি আরো বলেন, পুনরায় একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে কার্যকরী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা এবং ইসলামাবাদ উভয়ই এখন গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ শাসনামলে দক্ষিণ এশীয় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তীব্র অবনতি ঘটেছিল। এসময় উভয় দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনমন হয়েছিল এবং এক দেশ অপর দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা দেয়া উল্লেখযোগ্যহারে সীমিত করেছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং উভয় দেশের মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি, গঠনমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত।
স্বাধীনতা-পূর্ব সম্পদের বিভাজন থেকে উদ্ভূত আর্থিক পাওনা নিষ্পত্তিসহ দীর্ঘকাল ধরে বেশ কয়েকটি অমীমাংসিত ঐতিহাসিক ইস্যুগুলোর সমাধান ইসলামাবাদ করবে- এমনটাই আশা করে ঢাকা ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, ‘ভাগ করা সম্পদের কোন অংশ কে পাবে সেটি সমাধান করা দরকার।’
সফরসূচি অনুযায়ী, ইসহাক দার রবিবার বিকেলে একটি বিশেষ বিমানে ঢাকায় পৌঁছবেন এবং সোমবার সন্ধ্যায় দেশের পথে রওনা হবেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং দার সোমবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ‘তিনি (দার) বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।’
তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের কথা রয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কন্সাল্টেশন বা এফওসি অনুষ্ঠানে এই সফরের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। এই এফওসি ছিল ১৫ বছরের মধ্যে দুটি দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের অনুষ্ঠিত প্রথম বৈঠক।
এফওসি-পরবর্তী এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন,‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের প্রত্যাশায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। গ্রুপটির কাজ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে প্রস্তাবিত সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করা।’
এফওসি-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা ইসলামাবাদকে ঐতিহাসিক অভিযোগগুলো সমাধান করতে ‘দৃঢ় দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি’ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া এবং স্বাধীনতা-পূর্ব সম্পদের সাথে সম্পর্কিত বকেয়া ও আর্থিক সমস্যার সমাধান।
উত্থাপিত মূল বিষয়গুলোর মধ্যে আরো ছিল - আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, অবিভক্ত সম্পদের সুষম বণ্টন, ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রাপ্ত বিদেশি সাহায্য হস্তান্তর এবং ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত নৃশংসতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়া।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দকৃত ২০কোটি মার্কিন মার্কিন ডলার, অপরিশোধিত বৈদেশিক অনুদানের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্বাধীনতা-পূর্ব সাধারণ সম্পদের ৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত দেওয়ার দাবি করেছে।
উচ্চ পর্যায়ের সফর সম্পর্কে ঢাকার পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্লেষকরা বাসস’কে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক এফওসি-র রাজনৈতিক ফলোআপের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং সম্পদ নিষ্পত্তির বিষয়ে ইসলামাবাদের অবস্থান কী হতে পারে সে সম্পর্কে।
সাবেক কূটনীতিক এবং বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেছেন, পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দারের সফরের সময় এফওসি-তে উত্থাপিত বিষয়গুলো কিছু ফলাফল বয়ে আনতে পারে।
তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এফওসি-তে উঠে এসেছে এবং যদি ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে পুরোনো ক্ষত দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে ঢাকার সাথে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য ইসলামাবাদের এই ব্যাপারে আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, ইসহাক দারের ঢাকা সফরের সময় এফওসি পর্যায়ে আলোচনার ফলোআপ রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায় দিকনির্দেশনা পেতে পারে।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে যে আলোচনা হয়েছিল তার ফলোআপ দেখতে পাব বলে আশা করছি। সাবেক রাষ্ট্রদূত রহমান ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিভি/এসজি
মন্তব্য করুন: