ডিসেম্বর পর্যন্ত টিকার আওতার বাইরে ছিলো ৮০ শতাংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন বেদে, হিজড়া, ডোম, হরিজন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে টিকার আওতার বাইরে ছিলো ৮০ শতাংশ বা তার বেশি বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) সকালে ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন : অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানায় টিআইবি।
সরকার কর্তৃক বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ স্বত্ত্বেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও টিকা কার্যক্রম এবং করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গৃহীত প্রণোদনা কার্যক্রমে এখনও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সুশাসনের বিশেষত অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে, সংকট মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সাড়া প্রদান এবং সেবা সম্প্রসারণ করা হয়নি, যা ভবিষ্যৎ নতুন কোনো ঢেউয়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে প্রণীত গবেষণাটি উপস্থাপন করেন একই বিভাগের রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন ও রিসার্চ এসোসিয়েট কাওসার আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। গবেষক দলের অপর সদস্য হলেন- একই বিভাগের রিসার্চ এসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো- ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় সেরাম ইন্সটিটিউটের একক উৎস থেকে টিকা রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পর সরকারের প্রচেষ্টায় দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে চীন থেকে টিকা ক্রয়, কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে কস্ট শেয়ারিং বা বিনা মূল্যে টিকা সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান দিয়ে জুলাই ২০২১ থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করা। এসময় সরকারের তৎপরতায় ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ২৯.৬৪ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত টিকা থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১২.৭৭ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ (মোট জনসংখ্যার ৭৪.৯৬ শতাংশ) এবং ১১.২৪ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ (৬৬.০ শতাংশ) টিকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, প্রায় ৯৫ লাখ মানুষকে বুস্টার ডোজ প্রদান করা হয়। বিভিন্ন পেশা-জনগোষ্ঠীর মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি থেকে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থী, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
তবে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ স্বত্ত্বেও কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে এখনও সুশাসনের বহুবিধ চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যা এই কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বিশেষত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে। টিকাসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রণোদনা কার্যক্রম সকলের জন্য সমান প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না করায়, সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এলাকা, শ্রেণি, লিঙ্গ ও জনগোষ্ঠীভেদে বৈষম্য রয়ে গেছে। যা দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা থেকে বঞ্চিত করছে এবং হয়রানি ও আর্থিক বোঝা তৈরি করেছে। প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান থাকায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার সুফল প্রত্যাশিতভাবে পৌঁছায়নি। এছাড়া, স্বচ্ছতার ঘাটতি একদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির ঝুঁকি তৈরি করেছে ও অন্যদিকে সংঘটিত দুর্নীতিকে আড়াল করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেবা কার্যক্রমে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা নিরসনে বা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
গবেষণার ফল অনুযায়ী, কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রয়োজনের চেয়ে পরীক্ষাগার স্বল্পতা, সক্ষমতার অধিক সেবাগ্রহীতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে নমুনা পরীক্ষায় বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২৬.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতা কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন এবং ১৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে, নমুনা প্রদানের সময় পরীক্ষাগারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মানা, নমুনা দিতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ফিরে আসা, পরীক্ষাগারে কর্মীদের দুর্ব্যবহার, বাসা থেকে নমুনা দিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, নমুনা দিতে একাধিকবার কেন্দ্রে যাওয়া, ভুল প্রতিবেদন দেওয়ার কারণে পুনরায় পরীক্ষা করতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি অভিযোগের কথা জানা গেছে। নমুনা পরীক্ষার পর রিপোর্ট পেতে গড়ে ২.৫ দিন (সর্বোচ্চ ৯ দিন) এবং পরীক্ষাগারে নমুনা দিতে গিয়ে গড়ে ৩ ঘণ্টা (সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা) অপেক্ষা করতে হয়েছে। এছাড়া, পরীক্ষাগারের স্বল্পতা, অতিরিক্ত ভিড়, নমুনা প্রদানে জটিলতা, অতিরিক্ত খরচ ইত্যাদি কারণে নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে জনগণকে বিশেষত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, যারা সরকারি পরীক্ষাগারে নমুনা দিয়েছে তাদের ১৪.৯ শতাংশকে নির্ধারিত ফি অপেক্ষা গড়ে ১১৬ টাকা, যারা বাড়ি থেকে নমুনা দিয়েছে তাদের গড়ে ৬৪২ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে গড়ে ৪ হাজার ৪২৫ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়েছে। অনেক সময়ই বেসরকারি পরীক্ষাগারে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি অন্য পরীক্ষা করাতে বাধ্য করা হয়েছে। যথাসময়ে বা দ্রুত প্রতিবেদন পেতে ৪.৪ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে গড়ে ১৩৩ টাকা এবং পরীক্ষাগারে ভিড় এড়িয়ে দ্রুত নমুনা দিতে বা আগে সিরিয়াল পেতে ৬.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৬৬ টাকা নিয়ম-বহির্ভূত দিতে হয়েছে।
এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় নেগেটিভ সার্টিফিকেট পেতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশ থেকে প্রত্যাগতদের গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসা সেবায় সক্ষমতার ঘাটতি ও অনিয়ম দুর্নীতির ক্ষেত্রে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, নিজ জেলায় আইসিইউ সুবিধা না থাকায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ১৮.৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অন্য জেলা থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ৫.৪ শতাংশ সেবাগ্রহীতা হাসপাতালে শয্যা না পাওয়ায় বাড়িতে চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর শয্যা পেতে সেবাগ্রহীতাদের গড়ে ৩.৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সেবাগ্রহীতাদের ১৪.১ শতাংশ অনিয়মিতভাবে চিকিৎসকের সেবা পেয়েছেন, ১৪.৯ শতাংশের অক্সিজেন পেতে বিলম্ব হয়েছে, ১.৭ শতাংশের প্রয়োজন থাকলেও হাসপাতালে একবারও অক্সিজেন পাননি, ১৫ শতাংশ তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ভেন্টিলেশন সুবিধা পাননি, ১৩.৮ শতাংশ যথাসময়ে আইসিইউ সেবা পাননি এবং ৯ শতাংশ হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন সময়ে একবারও আইসিইউ সেবা পাননি।
সেবাগ্রহীতাদের তথ্যানুযায়ী, যথাসময়ে সেবা না পাওয়ায় হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়া ব্যক্তিদের ৭.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং ১১.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণকারীদের ২২.২ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে ১২.২ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে ৪০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ম-বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুই বছরে পরীক্ষাগার ও আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও তা অল্প কিছু জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখনও ৩৪টি জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষার সুবিধা নেই। ২০২০ সালের জুন মাসে সরকার থেকে সকল জেলা হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা স্থাপনের ঘোষণা করা হলেও এখনো ৩১টি জেলা হাসপাতালে এখনো আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়নি। অন্যদিকে জুন ২০২১ পরবর্তী সময়ে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ৯৪টি বৃদ্ধি পেলেও অধিকাংশই শহর কেন্দ্রিক এবং বেসরকারি। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৬ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস প্রকল্পের আওতায় জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, নমুনা পরীক্ষাগার স্থাপন, টিকা ও বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় করার কথা থাকলেও প্রায় দুই বছর পর তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি, কোভিড মোকাবিলায় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অনুদানের মাত্র ৬.৭ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে।
এছাড়া টিকা গ্রহণের সময় ১৫.৬ শতাংশ টিকাগ্রহীতা টিকা কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে টিকা কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করা (৮১.৩%), টিকা কেন্দ্রে দীর্ঘ সিরিয়াল (৫৮.২%), অপেক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা (৪৩.৩%), ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা না থাকা (৩১.৬%), বয়স্ক বা প্রতিবন্ধিবান্ধব পরিবেশ না থাকা (২৯.৯%), টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ কক্ষ না থাকা (২৪.১%), নোংরা পরিবেশ (১৫.১%), টিকা কর্মীদের দক্ষতায় ঘাটতি (১৪,২%), সব বুথ খোলা না থাকা (১০.৪%) ইত্যাদি। অন্যদিকে ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হন যার মধ্যে সময়ক্ষেপন, টিকা কেন্দ্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ও সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া, দুর্ব্যবহার, এবং কিছু কেন্দ্রে টিকা থাকা সত্ত্বেও টিকাগ্রহীতাদের ফিরিয়ে দেওয়া অন্যতম। অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে যথাসময়ে বা দ্রুত টিকা পেতে ১০.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৬৯ টাকা ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। এছাড়া প্রবাসীরা টিকার নিবন্ধনের জন্য বিএমইটি নম্বর পেতে ১৫০-২০০ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে টিকা না নিয়েও টাকার বিনিময়ে প্রবাসীরা টিকা সনদ সংগ্রহ করেছেন। এমনকি টাকার বিনিময়ে টিকা করা একটি গ্রুপ ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী টিকা/ সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়ে প্রচার করতে দেখা গেছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং প্রস্তাবিত কৌশল বাস্তবায়নে ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশে সরকারের জাতীয় টিকা পরিকল্পনায় গৃহীত অগ্রাধিকার তালিকার ধাপ অনুযায়ী অধিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে পরিপূর্ণভাবে টিকার আওতায় আনতে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। জরিপে দেখা যায়, কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার (১৩.২%) ও স্বাস্থ্য বিভাগের (১৭.৮%) উদ্যোগে খুব কম মানুষকেই উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে টিকা কেন্দ্রে অন্যের চেয়ে দেরিতে টিকা পেয়েছেন এবং অবহেলা, দুর্ব্যবহার ইত্যাদি অসমতার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন এলাকার প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মানুষের টিকা প্রাপ্তি জাতীয় পর্যায়ের অর্জনের চেয়ে নিচে অবস্থান করতে দেখা যায়। ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে ন্যূনতম একডোজ টিকার আওতায় আসা মানুষের হার ছিল ৪৪ শতাংশ। ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বেশ কিছু এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন বেদে, হিজড়া, ডোম, হরিজন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে টিকার আওতার বাইরে ছিল ৮০ শতাংশ বা তার বেশি। আবার টিকা কেন্দ্রের দূরত্ব, জটিল নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও খরচের কারণে প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার মানুষের টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ৮৬.৪ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে অন্যের সহায়তায় নিবন্ধন করতে হয়েছে। নিবন্ধন ও টিকা গ্রহণ করতে যাতায়াত বাবদ একজন টিকাগ্রহীতার মোট গড় খরচ ১০৬ টাকা, যা দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের একদিনের আয়ের চেয়ে বেশি।
এই গবেষণায় প্রাপ্ত সুশাসনের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো টিকা কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি। জুলাই ২০২১-এ গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে টিকা প্রতি ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে ১০ মার্চ ২০২২ তারিখে গণমাধ্যমে টিকা কার্যক্রমে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন। অথচ গবেষণায় দেখা যায় টিকা ক্রয় ও টিকা কার্যক্রমের প্রাক্কলিত মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রদত্ত হিসাবের অর্ধেকেরও কম। আবার শুধু একটি দেশের ক্ষেত্রে টিকার ক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার শর্ত থাকলেও অন্যান্য উৎস থেকে কেনা টিকার ব্যয় এবং টিকা কার্যক্রমে কোন কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি।
কোভিড অতিমারী মোকাবিলায় মোটাদাগে বাংলাদেশ সফল হলেও সুশাসনের আঙ্গিকে, বিশেষত অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে, ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “জাতীয় টিকা কার্যক্রম পরিকল্পনায় দুর্গম স্থানে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, বয়স্ক নাগরিক, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় গিয়ে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে এ লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম দেখা যায়নি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকাপ্রাপ্তির হার ৪৫ শতাংশর মতো, যা জাতীয় পর্যায়ে অর্জিত ৭৫ শতাংশের তুলনায় অনেক কম, বিষয়টি উদ্বেগের। তা ছাড়াও, টিকা নিতে গিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বৈষম্য, অবহেলা এবং দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্বুদ্ধকরণ এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ঘাটতিও লক্ষ করা গিয়েছে। অন্যদিকে, কোভিড মোকাবিলায় ব্যয় সম্পর্কিত কিছু তথ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোটাদাগে উল্লেখ করলেও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। সরকারি সূত্রে তথ্যের অনুপস্থিতিতে নির্ভরযোগ্য অন্য সূত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি যে ক্রয়সহ সার্বিক টিকা কার্যক্রমে খরচ হওয়ার কথা ১৩ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো, যেখানে মন্ত্রী বলেছেন খরচ হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই তারতম্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রকৃত ব্যয়ের তথ্য উন্মুক্ত না করার পেছনে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা ও গোপনীয়তার সংস্কৃতির পাশাপাশি সম্ভাব্য অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করার প্রয়াসও অন্তর্নিহিত কি-না!”
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ- নির্দিষ্টভাবে- অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ উত্তরণে টিআইবি ১০ দফা সুপারিশ করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- টিকা প্রাপ্তির উৎস, ক্রয়মূল্য, বিতরণ ব্যয়, মজুদ ও বিতরণ সম্পর্কিত তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে; কোভিড-১৯ চিকিৎসা ও টিকা সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে সরকারি ও প্রকল্পের বরাদ্দ যথাযথভাবে দ্রুততার সাথে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি জেলায় আইসিইউ শয্যা, আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন শেষ করতে হবে; বেসরকারি পর্যায়ের অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে টিকার আওতার বাইরে রয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের চিহ্নিত করে টিকার আওতায় আনতে হবে; প্রথম ডোজ পাওয়া বিশেষত- নিবন্ধনহীন টিকাগ্রহীতাদের দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করতে প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে; মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর, প্রতিষ্ঠান, গবেষক, উদ্যোক্তা সমিতির সহায়তায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে প্রণোদনা ঋণ আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য প্রচার করতে হবে ইত্যাদি।
বিভি/এইচএস
মন্তব্য করুন: