ঋণ-বিল খেলাপি: আরপিও-তে যা আছে, ইসি যা চায়

ছবি: বাংলাভিশন
গণপ্রতিনিধি আদেশ (আরপিও)-তে থাকা ঋণ ও বিল খেলাপি বিষয়টি আরো স্পষ্ট করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আর এই জন্য সোমবার (৬ জুন) ব্যাংক, সেবা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। তবে ইসির প্রস্তাবে সায় না দিলেও নিজেদের সুবিধার জায়গাটি আরো পোক্ত করার বিষয়ে মত দিয়েছেন সভায় যোগ দেওয়া সংশ্লিষ্টদের বেশিরভাগ।
জানা যায়, ঋণ ও বিল খেলাপিদের ভোটে আটকাতে শুধু মামলাকে প্রধান্য দিতে চেয়েছিল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। তাতে সম্মতি দেয়নি ব্যাংক ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকাভুক্ত হলেই খেলাপি হিসেবে ভোটে অযোগ্য থাকবেন। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) বিধানই বহাল রাখার পক্ষে মত দেন তারা।
সভাশেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আজকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অধিকাংশরাই বলেছেন, ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে এখন যে বিধান রয়েছে তা থাকলেই ভালো হয়। আমরা যেটা প্রস্তাব করেছিলাম- এটাতে উনারা খুব কমফোর্টেবল ফিল করেন না। আরো একটু চিন্তা করে ‘আরপিও সংশোধন করা হবে কিনা’ তা পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ব্যাংক ও সেবা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা যা বলছেন:
পূবালী ব্যাংকের জেনারেল ম্যানজার দেওয়ান রুহুল আহসান বলেন, আমরা ব্যাংকের পক্ষ থেকে সিআইবি রিপোর্টকে প্রাধান্য দিতে বলেছি। সেই সঙ্গে প্রচলিত আইন যদি সংশোধন করতে চায় তাহলে ওই অংশটি (মামলা) যুক্ত করতে পারে।
তিনি বলেন, সবার মতামতের নিয়ে প্রয়োজনে আরো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে কমিশন আশ্বস্ত করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলা করতে অসুবিধা নেই। মামলা তো করা হয়। সিআইবিতে যাদের নাম থাকবে তাদেরকে ঋণখেলাপি বলতে হবে। মামলা করতে অনেকগুলো ধাপ থাকে। সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
ইসির প্রস্তাবে ব্যাংকরা রাজি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অবজারভেশন দিয়েছি। সিআইবি তে যা আছে তা থাকবে।...মামলার কথা রাখতে চাইলে পাশাপাশি বিদ্যমান বিধানও রাখতে হবে।
ডেসকোর চিফ ইঞ্জিনিয়ার রশিদুর রহমান জানান, বিল খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধানে তাদের সম্মতি নেই। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধানই বহাল রাখার পক্ষে তারা মতামত দিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ে বিল পরিশোধ না করলেই বিল খেলাপি হয়ে যায় সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি গ্রাহককে জানানো হয়। কিন্তু মামলা করতে গেলে সেবা প্রতিষ্ঠানের নানা ঝুঁকিও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ইসির প্রস্তাবের পর আমাদের মতামতটা জানিয়েছি। রাখবেন কি রাখবেন না তা তাদের বিষয়। বিদ্যমান আইনই থাকুক। মামলাতে আমাদের সম্মতি ছিল না বলেন তিনি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-তে যা আছে:
সদস্য হইবার বা থাকিবার অযোগ্যতাসমূহ।- (১) কোনো নির্বাচনি এলাকার যে কোনে ভোটার উক্ত এলাকার সদস্য নির্বাচনের জন্য সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর অধীন সদস্য হইবার যোগ্য যে কোনো ব্যক্তির নাম প্রস্তাব বা সমর্থন করিতে পারিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তি সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হইবার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি-
(ট) তিনি, কৃষি কার্যের জন্য গৃহীত ক্ষুদ্র কৃষি ঋণ ব্যতীত, ঋণগ্রহীতা হিসাবে মনোনয়নপত্র জমা প্রদানের তারিখের পূর্ববর্তী সাত দিনের মধ্যে তৎকর্তৃক কোনো ব্যাংক হইতে গৃহীত কোনো ঋণ বা উহার কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হইয়া থাকেন;
(ঠ) তিনি এইরূপ কোনো কোম্পানির পরিচালক বা ফার্মের অংশীদার হন যারা কোনো ব্যাংক হইতে গৃহীত কোনো ঋণ বা উহার কোনো কিস্তি, মনোনয়নপত্র জমা প্রদানের পূর্বে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা ফার্ম কর্তৃক পরিশোধে ব্যর্থ হইয়াছেন;
(ড) তিনি ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বা সরকারের সেবা প্রদানকারী কোনো সংস্থার অন্য কোনো বিল মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনের পূর্ববর্তী সাত দিনের মধ্যে ব্যর্থ হইয়াছেন।
ইসি যা চায়:
সদস্য হইবার বা থাকিবার অযোগ্যতাসমূহ।- (১) কোনো নির্বাচনি এলাকার যে কোনে ভোটার উক্ত এলাকার সদস্য নির্বাচনের জন্য সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ (১) এর অধীন সদস্য হইবার যোগ্য যে কোনো ব্যক্তির নাম প্রস্তাব বা সমর্থন করিতে পারিবেন:
তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তি সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হইবার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি-
(ট) তাহার বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর অধীনে ঋণ আদায়ের কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো আদালতে মামলা অথবা কোন সরকারি সংস্থা বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরকারি পাওনা আদায় আইন, ১৯১৩ (Public Demand Recovery Act, 1913) এর অধীনে সার্টিফিকেট মামলা বা কোনো দেওয়ানি আদালতে কোনো দেওয়ানি মামলা এই আইনের ১২ ধারার অধীন মনোনয়ন আহ্বান করিবার অন্যূন ৬ (ছয়) মাস পূর্বে দায়ের হইয়া চলমান থাকে এবং মনোনয়ন দাখিলের পূর্বেই উক্ত মামলা বা, ক্ষেত্রমত, সার্টিফিকেট মামলা হইতে তিনি দায়মুক্ত না হইয়া থাকেন; এবং দফার বিধান নিম্নোক্ত শর্তসাপেক্ষে হইবে, যথা:-
(অ) এই দফার অধীন কোনো মামলা যদি কোনো বাণিজ্যিক কোম্পানি, ব্যাংক কোম্পানি বা যৌথ কারবারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (Partnership Firm under Partnership Act, 1932) এর বিরুদ্ধে দায়ের হইয়া থাকে, তাহা হইলে অনুরূপ বাণিজ্যিক কোম্পানি, ব্যাংক কোম্পানি বা যৌথ কারবারি প্রতিষ্ঠানের মালিক, শেয়ার হোল্ডার পরিচালক বা, ক্ষেত্রমত, অংশিদার এই দফার অধীন অযোগ্য গণ্য হইবেন না, যদি মামলা দায়ের হইবার পূর্বেই তিনি উল্লিখিত বাণিজ্যিক কোম্পানি, ব্যাংক কোম্পানি বা যৌথ কারবারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, শেয়ার হোল্ডার পরিচালক, ক্ষেত্রমত, অংশিদার হিসাবে তাঁহার স্বত্ত্ব ত্যাগ করিয়া থাকেন; এবং
(আ) এই দফার অধীন দায়েরকৃত মামলার ধারাবাহিকতায় উচ্চতর কোনো আদালতে রীট, আপিল, রিভিশন বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা ঋজু করা হইলে বা চলমান থাকিলে, মূল মামলা চলমান রহিয়াছে মর্মে গণ্য হইবে; এবং উচ্চতর কোনো আদালত কর্তৃক উক্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হইলে উক্ত কারণে উক্ত মামলা চলমান নহে মর্মে গণ্য করা যাইবে না।
বৈঠকে সিইসি, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বৈঠকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরর অতিরিক্ত সচিব (ড্রাফটিং) হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ডিন ডক্টর সীমা জামান, ডেসকো'র চিফ ইঞ্জিনিয়ার রশিদুর রহমান, ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজিজুল হক পান্না, আইন ও বিচার বিভাগের উপ সচিব প্রশাসন (জেলা জজ) শেখ গোলাম মাহবুব, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (বি আর পি ডি) মাকসুদা বেগম, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড'র জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল কদ্দুস, বিটিসিএল'র জেনারেল ম্যানেজার (ফিন্যান্স এন্ড বাজেট) মাজহারুল ইসলাম, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক'র স্পেশাল এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (ডিভিশনাল হেড) মীর ইকবাল হোসেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক'র কান্ট্রি হেড নুর হোসাইন আল কাদেরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (বাজেট) ফারুকুজ্জামান, তিতাস গ্যাস লিমিটিড'র পরিচালক (অর্থ) অর্পণা ইসলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আউয়াল কমিশনকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। নিয়োগ পাওয়ার পরদিন শপথ নিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রথম দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন শুরু করে নতুন কমিশন। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার দায়িত্বভার পাওয়ার পরপরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপের সিদ্ধান্ত নেন।
সেই আলোকে গত ১৩ ও ২২ মার্চ এবং ৬ ও ১৮ এপ্রিল যথাক্রমে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী এবং নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি।
বিভি/এইচকে
মন্তব্য করুন: