• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-৩

৭ কোটি টাকার প্রচারণাঃ তবু কেউ জানে না, কেউ মানে না (ভিডিও)

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৬ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৭:৪২, ২০ মার্চ ২০২২

ফন্ট সাইজ

বাংলাদেশের বিরল জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একমাত্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছে সরকার। এখানে পর্যটকদের পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম ঠেকাতে ১৪টি বিধি-নিষেধ দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। এসব নিষেধাজ্ঞা জনগণকে জানাতে এবং মানাতে ৫ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পও পরিচালনা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ  শীর্ষক এই প্রকল্পের অধীনে শুধু বিজ্ঞাপন খাতেই ব্যয় করা হয়েছে ৭ কোটি টাকা।  

পরিবেশ অধিদফতরের প্রচার করা গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দ্বীপের সৈকতে সব ধরনের যান্ত্রিক এবং অ-যান্ত্রিক যান পরিচালনা নিষিদ্ধ; সৈকত, সমুদ্র এবং নাফ নদীতে প্লাস্টিক ফেলা; পশ্চিম পাশের সৈকত কোণাপাড়ার পর দক্ষিণ পাশের সৈকত গলাচিপার দক্ষিণ দিকে পরিভ্রমণ, দ্বীপের চারপাশে নৌভ্রমণ করা, জোয়ার-ভাটা এলাকায় পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটা; সামুদ্রিক কাছিমের ডিমপাড়ার স্থানে চলাফেরা করা; রাতে আলো জ্বালানো এবং ফ্লাশ লাইট ব্যবহার করে ছবি তোলা, আতশবাজি পোড়ানো, সৈকতে উচ্চশব্দে গান-বাজনা করা, মাইক বাজানো, বার-বি-কিউ পার্টি ইত্যাদি নিষিদ্ধ।

এছাড়া দ্বীপের ছেঁড়াদিয়া অংশে কোনোক্রমেই ভ্রমণ এবং নোঙর করা যাবে না; প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, সামুদ্রিক পাখি, তারামাছ, কাছিম, রাজ কাঁকড়া, সামুদ্রিক ঘাস, সামুদ্রিক শৈবাল এবং কেয়া ফল সংগ্রহ এবং ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না; জাহাজ থেকে পাখিকে চিপস এবং কোনও রকম খাবারও খাওয়ানো যাবে না; দ্বীপে সুপেয় পানি কম থাকায় পানির অপচয় না করা এবং দ্বীপের প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনও কিছু করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বলা হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে কতোটুকু?

সেন্টমার্টিনে এসব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে নেওয়া প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ২০২১ সালের জুনে। প্রকল্প চলাকালে ২০২১ সালের মার্চে এবং প্রকল্প শেষে একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বীপ পর্যবেক্ষণে গিয়ে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং আগের ধ্বংস আরও সুস্পষ্ট হতে দেখা গেছে। 

পরিবেশ অধিদফতরের গণবিজ্ঞপ্তি বলছে, কাছিমসহ সামুদ্রিক প্রাণী প্রজণনের স্বার্থে এই দ্বীপে রাতের সৈকতে আলো জ্বালানো এবং উচ্চ শব্দ তৈরি করা নিষিদ্ধ। কিন্তু পর্যবেক্ষণে গিয়ে দেখা যায়, রাতভর রিসোর্টে রিসোর্টে জ্বলে রঙ-বেরঙের ঝাড়বাতি, চলে বার-বি-কিউ পার্টির নামে বাদ্যযন্ত্রের তালে উচ্চ শব্দে নাচ-গান। 

গত ১২ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় দ্বীপের মূল বিচের মারমেইড রিসোর্টের সামনে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন তরুণ বার-বি-কিউ পার্টি করছেন। উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে নাচতেও দেখা যায় তাদের। সেখানে সাউন্ড লেভেল মিটার চালিয়ে দেখা যায়, শব্দমান উঠেছে গড়ে ৮৫ থেকে ৯৫ ডেসিবেল পর্যন্ত। অথচ পরিবেশ অধিদফতরেরই মানদণ্ডে মানুষের স্বাভাবিক সহ্য ক্ষমতা ৫০ ডেসিবেল। যা প্রাণীদের জন্য আরও কম।

একইদিন সকাল ১১টায় সমুদ্র বিলাস রিসোর্টের সামনের বায়ুমান যাচাই করে দেখা যায়, সেখানকার পার কিউবিক মিটার বায়ুতে পিএম২.৫ এর উপস্থিতি ছিলো মাত্র ১৫ মাইক্রোগ্রাম। অথচ রাত ১১টায় বার-বি-কিউ পার্টির সুবাদে সেখানকার তা পৌঁছায় ৩০০ মাইক্রোগ্রামের কাছাকাছি (পরিবেশ অধিদফতরের মানদণ্ডে পার কিউবিক মিটার বায়ুতে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পিএম২.৫ এর উপস্থিতি স্বাভাবিক ধরা হয়)। পাশাপাশি জেনারেটরের উচ্চ শব্দ, ঝাড়বাতির আলো তো আছেই।

এতো গেলো শব্দ ও বায়ুদূষণের গল্প। নির্দেশনা অনুযায়ী দ্বীপের সৈকতে বিচরণকারী ছোট ছোট প্রাণীদের বাঁচাতে সৈকতে সব ধরনের যানবাহন চালানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা লেখা সাইনবোর্ডও রয়েছে সৈকতের বিভিন্ন স্থানে। অথচ দিব্যি চলছে সাইকেল থেকে শুরু ইজিবাইক পর্যন্ত সবই। যার ধংসযজ্ঞের চিত্র ধরা পড়বে যে কারো চোখে।

অধিগ্রহণসূত্রে সেন্টমার্টিনের ছেঁড়াদিয়া অংশের মালিকানা পরিবেশ অধিদফতরের। সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন হওয়ায় এখানে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এখানেও কে মানে কার কথা। 

জানতে চেয়েছিলাম, বেশ কয়েকজন বাইক চালকের কাছে। আব্দুল মালেক নামে চট্টগ্রাম থেকে আসা এক পর্যটক সৈকতে মোটরবাইক চালাচ্ছিলেন। প্রশ্ন করলে তিনি দাবি করেন, নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানলে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে আসতেন না।

আরেকজনকে মোটরসাইকেল কোথায় পেয়েছেন জিজ্ঞাসা করলে জানান, ৪০০ টাকা ঘণ্টায় ভাড়া পাওয়া যায়। তাই ভাড়া নিয়ে সৈকতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। 

সৈকতে যাত্রী নিয়ে ইজিবাইকও চলতে দেখা যায়। জানতে চাইলে রমিজ উদ্দিন নামে এক চালক বলেন, কোস্টগার্ড থাকলে বিচে নামি না, নইলে মাঝে মাঝে নামি। দ্বীপের ভেতরের রাস্তা ভালো না তো। ভালো থাকলে সেই রাস্তা দিয়েই ছেঁড়াদিয়ায় যেতাম।  

আসাদুল ইসলাম নামের এক পর্যটক বলেন, নিষেধ শুনেছি। কিন্তু সবাই আসছে দেখে অল্প অল্প করে আসতে আসতে ছেঁড়াদিয়ায় চলে এসেছি। কই ম্যাজিস্ট্রেট তো দূরে থাক, কোনো চৌকিদারও দেখিনি।

নদী বা সাগরে প্লাস্টিক ফেলার প্রসংগ না হয় বাদ দিলাম। জাহাজ থেকে পাখিদের চিপস দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞাও মানছেন না কেউ। প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর এসব পণ্য দিব্যি বিক্রি হচ্ছে জাহাজেই কিন্তু ঠোকানোরও কেউই নেই। এভাবেই সংকটাপন্ন এই দ্বীপ প্রতিনিয়ত গভীর সংকটের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমুদ্র বিষয়ক পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি’র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, পুরো প্রকল্পে উল্লেখ করার মতো কাজই হয়েছে শুধু প্রচারণায়। কিন্তু সেই প্রচারণাও হয়েছে উল্টো সময়ে। ট্যুরিস্ট সিজনে এসব প্রচারণা না চালিয়ে অফ সিজনে চালানো হয়েছে। তাই টাকা গেলেও সুফল মেলেনি।

তিনি আরও বলেন, ট্যুরিস্টরা আসার সময় বা জাহাজে বসে জানতে পারেন এখানে অনেক কিছু নিষিদ্ধ। কিন্তু দ্বীপে পৌঁছে দেখেন নিষেধাজ্ঞার ছিঁটেফোটাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তখন যিনি মানার নিয়তে এখানে আসেন, অন্যের দেখাদেখি তিনিও আইন ভাঙেন। 

প্রকল্পটিকে ব্যর্থ দাবি করে, এই দ্বীপ সংরক্ষণের কাজ প্রকল্পের মাধ্যমে না করে পরিবেশ অধিদফতরের ম্যান্ডেট হিসেবে করলে এবং নিজস্ব জনবলের সংগে অন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সম্পৃক্ত করা গেলে দ্বীপের অবস্থা এমন হতো না বলেও মন্তব্য করেন এই পরিবেশবাদী নেতা।   

এই প্রসংগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিবেশ অধিদফতরের মূল দায়িত্ব পরিবেশ রক্ষা করা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান এখন প্রকল্পনির্ভর হয়ে পড়ায় তারা পরিবেশ রক্ষার চেয়ে ধংসই বেশি করছে। প্রকল্পের কারণে এরা নিজেদের দায়িত্ব পালন বাদ দিয়ে প্রকল্পের পেছনে ঘুরছে। এছাড়াও অন্যতম কারণ জবাবদিহিতার সংকট। ঊর্ধ্বতন প্রতিষ্ঠান তাদের কোনো জবাবদিহিতা চায় না। এতে প্রতিষ্ঠানটি নিজেই এখন ধংসকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। 

এই বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দারের সংগে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। পরে প্রশ্ন পাঠালেও উপরের নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে বারবার কালক্ষেপণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত কথা বলেননি।

আরও পড়ুন: পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-১ >> প্রকল্পের ১২ কোটি টাকা ফুরিয়েও ক্রিটিক্যাল এলাকায় পুড়ছে প্লাস্টিক

আরও পড়ুন: পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-২ >> সেন্টমার্টিনঃ সংরক্ষণ প্রকল্পের মধ্যেই চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ

** ৫ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ৪র্থ পর্ব পড়ুন আগামী বুধবার (১৯ জানুয়ারি) বিভিনিউজ২৪-এ

বিভি/কেএস/এসডি

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2