• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-৫

সেন্টমার্টিনঃ প্রকল্পের ২৬ হাজার গাছ গেলো কই? (ভিডিও)

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৭:৩৯, ২০ মার্চ ২০২২

ফন্ট সাইজ

দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনের এখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এ নিয়ে ভাবনার শেষ নেই নানান মহলের। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে চলে হরদম আলোচনা-সমালোচনা। কেউ পর্যটক কমানোর কথা বলেন, কেউ বলেন পর্যটক কমলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন ব্যবস্থা। এই সুযোগে সংরক্ষণের নামে কেউ করেন প্রকল্প বাণিজ্য।  

বিরল প্রতিবেশ সংরক্ষণের কথা মাথায় রেখে ১৯৯৯ সালে এই দ্বীপকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। এরপর ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দ্বীপের প্রতিবেশ সংরক্ষণে বাস্তবায়ন করা হয় ৩টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল টাকা খরচ হলেও সুরক্ষা পায়নি প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপটি। বরং একে একে ধংসের পথে এগিয়েছে সেন্টমার্টিন।

সবশেষ ২০১৬ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ শীর্ষক ৫ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প শুরু করে পরিবেশ অধিদফতর। দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও ইকো ট্যুরিজম ব্যবস্থার উন্নয়ন, যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে দ্বীপের কোরাল, ফ্লোরা ও ফ’না সংরক্ষণ; বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলা এবং এসব কাজে পরিবেশ অধিদফতরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংশ্লিষ্টদের সংগে অভিজ্ঞতা বিনিময় ছিলো এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য।

২০২১ সালের জুনে শেষ হয় প্রকল্পটির মেয়াদ। এই সময় প্রকল্পের সম্পাদিত কাজের তালিকায় বলা হয়, প্রকল্প চলাকালে সেন্টমার্টিনে নারিকেল, কাঠ বাদাম ও কেয়া গাছসহ প্রায় ২৬ হাজার বৃক্ষ রোপনের পাশাপাশি করা হয়েছে ম্যানগ্রোভ বনায়ন। এতে হিসাব দিয়ে বলা হয়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০ হাজার কেয়া গাছ, ৩০০ নারিকেল গাছ এবং ৩০০ কাঠবাদাম গাছ রোপন করা হয়েছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার কেয়া গাছ, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪ হাজার কেয়া গাছ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৭ হাজার কেয়া গাছ রোপন করা হয়েছে। করা হয়েছে ম্যানগ্রোভ বনায়নও। একইসংগে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য স্থানীয়দের এক হাজার নারিকেল গাছের চারাসহ বিভিন্ন ফসলের বীজও সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানানো হয়।  

প্রকল্পের নথি যাচাই করে দেখা যায়, এই প্রকল্পে বৃক্ষ রোপনের জন্য ১০ লাখ টাকা ও ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ এবং পুনঃস্থাপনের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিলো। নথি বলছে, যার ৯৮ শতাংশ টাকাই ব্যয় হয়েছে, বাস্তবায়ন হয়েছে বৃক্ষরোপন কার্যক্রম। যদিও একাধিকবার সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা মেলেনি কাঙ্ক্ষিত বনায়ন।

আসলেই কী বনায়ন বেড়েছে? জানতে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর সহযোগিতায় প্রকল্প শুরুর আগে (২০১৫ সাল) ও প্রকল্প শেষের (২০২১ সাল) স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে বনায়নের পরিমাণ যাচাই করেন এই প্রতিবেদক। এতে ২০১৫ সালে পুরো সেন্টমার্টিনে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা পাওয়া যায় ১.৭৯ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু ২৬ হাজারের বেশি বৃক্ষ রোপনের পরও প্রকল্প শেষে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা পাওয়া যায় ১.৫৯ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ হিসাব বলছে, বনায়ন বাড়ার পরিবর্তে ৫ বছরে ১১.২ শতাংশ কমেছে।

সেন্টমার্টিনের বড় সমস্যা অতিরিক্ত পর্যটক। বিশেষজ্ঞরা এই দ্বীপের সর্বোচ্চ পর্যটক ধারণক্ষমতা ১২শ’ জন বললেও পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন এখানে আসেন প্রায় ৮ হাজার পর্যটক। মূলতঃ বাড়তি পর্যটকের চাহিদার যোগান দিতেই এখানে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে হোটেল-রিসোর্ট, যার কারণে বৃক্ষ নিধনসহ নানান বিধ্বংসী কার্যক্রমে বিলীন হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। নষ্ট হয়েছে মিঠাপানির রিজার্ভারটিও।

এমন পরিস্থিতিতে দ্বীপের বিরল জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিভিন্ন মহল থেকে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ উঠে এসেছে বহুবার। এই পরামর্শ বাস্তবায়নও ছিলো প্রকল্পটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কথা ছিলো ১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বাজেটের এই প্রকল্পের অধীনে গড়ে তোলা হবে ট্যুরিস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। যার মাধ্যমে একজন পর্যটকের বারবার সেন্টমার্টিন ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত পর্যটক নিয়ন্ত্রণের কথা ছিলো।

প্রকল্পের সম্পাদিত কাজের তালিকায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের অধীনে ‘ওয়েব বেইজড ট্যুরিস্ট রেজিস্ট্রেশন ও ইনফরমেশন মেনেজমেন্ট সিস্টেম’ তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকের সংখ্যা নির্ণয়ে জেটিঘাটে লাগানো হয়েছে আইপি ক্যামেরা। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে ৭ মাস পার হলেও এখনো দৃশ্যমান হয়নি এর কিছুই। 

প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা ছিলো, দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও ইকো ট্যুরিজম ব্যবস্থার উন্নয়ন; যথাযথ গবেষণার মাধ্যমে দ্বীপের কোরাল, ফ্লোরা ও ফ’না সংরক্ষণ এবং এসব কাজে পরিবেশ অধিদফতরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংশ্লিষ্টদের সংগে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে।

প্রকল্প শেষে জানানো হয়, প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের অবস্থা ও স্থানীয়দের জীবনযাত্রা নিয়ে সমীক্ষা চালানোর পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। করা হয়েছে পর্যটক ধারণক্ষমতার সমীক্ষাও। কিন্তু এসব তৎপরতাও দৃশ্যমান তো হয়ইনি, এখনও এর কোনোটিই প্রকাশ করা হয়নি গণমাধ্যম কিংবা কোনো মাধ্যমেই। গবেষণার মাধ্যমে সংরক্ষণ পদ্ধতি গড়ার বিপরীতে অভিযোগ উঠেছে  কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই কোরাল ও প্রবালসমৃদ্ধ এলাকায় নৌকার বয়া স্থাপনের।

এদিকে দ্বীপে জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর কাজ ঠেকাতে প্রকল্পের অধীনে ৩টি গ্রাম সংরক্ষণ দলকে ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছিলো বলে জানানো হয় প্রকল্প শেষে। কিন্তু সেন্টমার্টিনে গিয়ে তাদেরও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

বয়া স্থাপনের বিষয়ে জানাতে চাইলে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর সাবেক ডুবুরি এবং ওশেন আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরার এস এম আতিকুর রহমান বাংলাভিশন ডিজিটালকে বলেন, সেন্টমার্টিনের বিচের কাছে হার্ড কোরাল রয়েছে, দূরে আছে সফট কোরাল। এজন্যই এখানে নৌকার নোঙর না ফেলার কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু নোঙর ঠেকানোর জন্য যে বয়া দেওয়া হয়েছে, এক্ষেত্রে কোনো সমীক্ষা করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

তিনি বলেন, পাশের বয়াটি পুরোপুরি কোরাল এলাকায় দেওয়া হয়েছে। অন্যগুলোও বেশি দূরে না। বয়াগুলো কোন্ স্ট্রাকচারে বসানো হয়েছে সেটা জানি না। এখানে আমি ডাইভ করে দেখিনি। যদি নিচে এর কোনো স্ট্রাকচার থেকে থাকে, তাহলে নিশ্চয় এর মাধ্যমে কোরাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বয়ার সুফল পেতে হলে কেন এটি স্থাপন করা হচ্ছে, বিষয়টি চিঠি বা নির্দেশনা আকারে নৌযান চালক, বোট মালিক সমিতি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ সংশ্লিষ্টদের জানানোর প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমার জানা মতে কাউকে এই বিষয়ে অবহিত করা হয়নি। বিশেষ করে আন্ডারওয়াটার এক্সপার্টদের কারো পরামর্শ নেওয়া হয়েছে বলে তাঁর জানা নেই বলেও মন্তব্য করেন সমুদ্রতলের এই বিশেষজ্ঞ।  

বনায়ন হ্রাস প্রসংগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের কাগজপত্রে যে দশ, বিশ, ত্রিশ হাজার গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে, তা কি আসলেই লাগনো হয়েছে, নাকি শুধু কাগজেই লেখা হয়েছে, সেটা খোঁজ নেওয়া দরকার। কারণ ৩-৪ বছরের ভেজিটেশনের যে ডাটা দেখা যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। গাছ লাগালে তো এতো কমার কথা না।

তিনি আরও বলেন, ম্যানগ্রোভ অংশে বনায়নের কিছু নেই। দরকার শুধু এটাকে আনডিস্টার্বড রাখা। ডিস্টার্ব না করলে ম্যানগ্রোভ নিজেই বেড়ে ওঠে। তবে যেখানে মানুষের স্ট্রেচ বেশি, সেখানে বেশি বেশি বনায়ন করতে হবে। কারণ এই দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে বৃক্ষ রোপনের বিকল্প নেই।

পরিবেশ ও জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসাইন খান বলেন, পরিবেশ অধিদফতরের দ্বিমুখী ভূমিকা বন্ধ হওয়া উচিত। একদিকে তারা রেগুলেটরি বডি হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে নিজেরাই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সমস্যার কথা হলো, তারা যেখানেই প্রকল্প করতে গিয়েছে সেখানেই তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যার বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, সে আবার অন্যকে আইন দেখাতে গেলে সেটা বেমানান হয়। পরিবেশের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। দুই দিকে কাজ করতে গিয়ে এখন দুই কূলই হারাচ্ছে।

জবাবদিহিতার সংকটের কারণে পরিবেশ অধিদফতরে অনিয়ম দুর্নীতি বেড়েছে বলে মন্তব্য করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পের ওপর নিরপেক্ষ তদন্ত করার দাবি জানান জাকির হোসাইন খান। সমস্যা থেকে উত্তরণে পরিবেশ বিষয়ক একটি জাতীয় কমিশন গঠন এবং জনগণকে উদ্যোগী হয়ে এসব প্রকল্পের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।  

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সোলায়মান হায়দার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তিনি জানান, কাজ না করায় বাতিল করা হয়েছে গ্রাম সংরক্ষণ দলের বরাদ্দ। 

এছাড়া পর্যটক নিয়ন্ত্রণসহ সমীক্ষা প্রতিবেদনগুলো উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বলেও জানান পরিবেশ অধিদফতরের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

আরও পড়ুনঃ 
পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-১ >> প্রকল্পের ১২ কোটি টাকা ফুরিয়েও ক্রিটিক্যাল এলাকায় পুড়ছে প্লাস্টিক (ভিডিও)
পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-২ >> সেন্টমার্টিনঃ সংরক্ষণ প্রকল্পের মধ্যেই চলেছে ধ্বংসযজ্ঞ (ভিডিও)
পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-৩>> ৭ কোটি টাকার প্রচারণাঃ তবু কেউ জানে না, কেউ মানে না (ভিডিও)
পরিবেশ অধিদফতরের প্রকল্প বাণিজ্যঃ পর্ব-৪>>> সেন্টমার্টিনঃ ইসিএ আইনও লঙ্ঘন হয়েছে সরকারি টাকায় (ভিডিও)

বিভি/কেএস/এসডি

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2