• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

ছাগলামিতে পাগলামির আনলিমিটেড বাঙলামি

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ১২:২০, ২৮ জুন ২০২৪

ফন্ট সাইজ
ছাগলামিতে পাগলামির আনলিমিটেড বাঙলামি

দুর্নীতিবাজরা ইন্ডিভিজ্যুয়াল নয়। তারা কালেকটিভ। কেবল স্বামী-স্ত্রী-সন্তান, শশুর নয়, আশপাশের হোতারা লতায়পাতায় জড়িত। দাতা-গ্রহীতা মিলিয়ে তাদের একটা নেটওয়ার্ক সবখানেই। ঘটনাচক্রে এক্সিডেন্টালি ফেঁসে গেলে এদিকওদিক ঢুস মারে। যশোরের ছাগলের ঢুসে এখন নানাদিক একাকার। কারো কারো জন্য ছাগলটি যমদূতের মতো।

বেনজীর-মতিউরের পর এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে-বেনামে থাকা সব স্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালসহ ১৪ জনের ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ছয় কোটি ৯৬ লাখ টাকা ফ্রিজ করেছেন আদালত। পাশাপাশি ফয়সালসহ সাতজনের নামে থাকা ১৫টি সঞ্চয়পত্রে থাকা দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। 

এর আগে, ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর এনবিআরের সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি ছাড়াও ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের আটটি ব্যাংক হিসাব ও বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব) স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এখন জব্দ করা হলো ফয়সালের স্ত্রী আফসানাসহ চারজনের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ। ফয়সালের সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ আদালতে তুলে ধরে বলা হয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের উৎস গোপনের জন্য নিজের নামসহ আত্মীয়-স্বজনের নামে সাতশ'টির বেশি হিসাব খোলেন তিনি। উদ্দেশ্য, অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস গোপন করা। মতি-বেনজীরদের দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও এসব খবরের প্রেক্ষিতে সরকারের পদক্ষেপের চেয়ে নাগরিকদের মধ্যে অভিযুক্তদের নিয়ে ট্রল করার প্রবণতাই বেশি। কিছুটা ‘বিনোদন আইটেম’। এই বিনোদনের মাঝেই ১৪ দিন আত্মগোপনের পর খোঁজ মিললো ছাগলকাণ্ডে মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরার উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকীর। বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে যান তিনি। বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান তিনি। 

একইদিন ছাগলকান্ডে আলোচিত সাদেক এগ্রোর খামারে উচ্ছেদে যায়  ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। হতভম্ব হয়ে যান সাদেক এগ্রোর লোকেরা । কোনো নোটিশ বা চিঠি না দিয়ে চালানো এ অভিযানকে অলৌকিক বলে মনে হয় তাদের কাছে। ঘটনা অনেকটাই সোফায় ড্রাইভারের সঙ্গে স্ত্রীর বিশেষ কর্ম দেখে এক মনিবের জেদে বিছনা চাদর ছিঁড়ে ফেলার শুকনা গল্পের মতো।  এক গৃহকর্তা কোনো এক মধ্যাহ্নে বাসায় ঢুকে দেখেন তার স্ত্রী অন্তরঙ্গভাবে ড্রাইভারের সাথে খাটে মাস্তি করছেন। ভদ্রলোক ক্ষেপে চটাং। প্রতিকার হিসেবে বিছনা চাদরটা একটানে ছিঁড়ে ফেলেন। সাদেক এগ্রো হঠাৎ বা নতুন গজানো নয়। গত বছর কয়েকে এটি বেশ নামকরা। বছর কয়েক আগে, ২০২১ সালে ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে ধরা পড়ে আমদানি নিষিদ্ধ ১৮টি ব্রাহমা গরু। গরুগুলোকে ছাড়াতে জমা দেয়া হয় সব ভূয়া কাগজপত্র। আমদানিকারক কিংবা তার প্রতিনিধি শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে বিল অফ এন্ট্রিও জমা দেননি, যেটি চালান দেশে পৌঁছানোর আগে বা পরে জমা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করার প্ল্যান ‘এ’ ব্যর্থ হওয়ার পর একটি ধরাবাঁধা প্রক্রিয়া চলার কথা ছিল। প্রথমে শুল্ক কর্মকর্তারা গরু জব্দ করবেন এবং তিন সপ্তাহ অপেক্ষার পর সেগুলোকে নিলামে তুলবেন। কিন্তু যদি প্ল্যান বি, অর্থাৎ নিলাম থেকে গরুগুলোকে কিনে নেওয়া, অথবা প্ল্যান সি, আদালতে জরিমানা দেওয়ার ব্যাপারটি কাজ করতো, তাহলে আমদানিকারক সাদিক এগ্রো লিমিটেড ঠিকই ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্রিডের এসব বিশাল আকৃতির ষাঁড়গুলোকে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার খামারে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু কোন অজানা কারনে সবকিছু ভজঘট পাকিয়ে যায়। গরুগুলো বাজেয়াপ্ত হয়ে এদের ঠাই হয় সাভারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় গো–প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে। 

এই গরুগুলোকেই 'কোটি টাকার গরু' নামে বাজারে ওঠানো হয়। সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা গরু আবার সাদিক এগ্রোতে চলে যাওয়ার রহস্য কেউ ভেদ করতেও চাননি। এটিও দেশের প্রকাশ্য দুর্নীতি আর কালো টাকার দৌরাত্বের উদ্ধত নমুনা। এখানে বড় বড় গরু প্রকাশ্যে এরোপ্লেনে করে উড়িয়ে দেশের সবচাইতে বড় বিমানবন্দরে নামানো যায়। সরকারের নানা স্তরের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এমন কাণ্ডকীর্তি সম্ভব? প্রশ্ন আরো আছে। আড়াই লাখ টাকা মূল্য ঘোষনা দিয়ে নিয়ে আসা গরু কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে খবর রটবে কেন? যে ছাগল বিক্রি হয়নি, সেই ছাগল ১২ লক্ষ টাকায় বিক্রির খবর প্রচার করা হয় কেন? সাদিক এগ্রোর পার্টনার কারা? কাদের কালোটাকা কোটি টাকার গরু বিক্রির টাকা দেখিয়ে সাদা করা হচ্ছে? শয়ে শয়ে ব্রাহমা গরু আমেরিকা থেকে আমদানির নামে দেশের টাকা কি বিদেশ পাচার হয়নি? মিলবে এসব প্রশ্নের জবাব?

জবাব না থাকলেও কথামালার শেষ নেই। সংসদে বক্তৃতায় মাহবুবুল হক হানিফ বলেছেন, একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা হলে তাদের গ্রেপ্তারে কোনো পারমিশন লাগে না। কিন্তু যদি সরকারি কর্মীদের একই অভিযোগে মামলা হয়, তাহলে গ্রেপ্তার করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি লাগে। এই সরকারি কর্মকর্তা আইন ২০১৮ এটাই দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছে। তিনি আইনটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। বলতে বলতে হানিফ আরো বলেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহিষ্ণুতা) নীতি ঘোষণা করেছে। তারপরও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং আরও নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাঁদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম শুনিয়েছেন আরেক কথা। তার ভাষায়: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ করে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। এটা ষড়যন্ত্রের অংশ, কিন্তু তারপরও এগুলো সত্য।

সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন এমপির কথা আরো কড়া। তার মতে, সরকারি কর্মকর্তারা দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। কিন্তু, সব দোষ হয় রাজনীতিকদের।  কথার বোম ফাটালেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামও।  দেশে দুর্নীতির পরিমাণ আগের চেয়ে যথেষ্ট কমেছে বলে দাবি তার। তাজুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান সবাই যুদ্ধ করে। তাই কেউ বলতে পারবে না উন্নত দেশে দুর্নীতি নেই। সাদেক এগ্রোর বিরুদ্ধে এতোদিন পরে অভিযান কেন এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, যখন যেটা নজরে আসে, তখন সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমন নজর ও নজরানার মাঝে কী বলতে গিয়ে কী খেয়ে ফেলার এই চলতি মৌসুমে পরীমনিই বা বাদ থাকবেন কেন? সেখানেও প্রাসঙ্গিক পুলিশ। ভাইরাল হওয়ার মচ্চবে আর প্রেম করবেন না জানানোর পর পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েন বেচারা বরখাস্ত। ভাইরাল হওয়া ছবিতে বলা কঠিন- পরীমনি গোলাম সাকলায়েনকে খাইয়ে দিয়েছে না খেয়ে দিয়েছে? এরমধ্যেই আরো ভাইরাল হয়েছেন ‘রিমান্ডে তার সঙ্গে কী করা হয়েছে তা বলতে চান না’ জানিয়ে। পরীমনি এদিক থেকে নির্ভার। জেদে বা ক্ষেপে কেউ ছাদর ছিঁড়ে ফেলবে, সেই ঝুঁকি নেই পরিমনীর।  
 

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

বিভি/এমএফআর

মন্তব্য করুন: