• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

মতি-বেনজীরদের বন্ধুভাগ্য: কমন শত্রু সাংবাদিক

মোহাম্মদ অলিদ বিন সিদ্দিক তালুকদার

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ৩০ জুন ২০২৪

ফন্ট সাইজ
মতি-বেনজীরদের বন্ধুভাগ্য: কমন শত্রু সাংবাদিক

বেনজীর-মতি-আজিজ মিলিয়ে দুর্নীতিবাজদের প্রতিপক্ষ সাংবাদিকরা। দুর্নীতিবাজ-কালপ্রিটদের মিতালি কেবল স্বামী-স্ত্রী-সন্তান, শ্বশুর-দুলাভাইতে নয়, আশপাশে তাদের হিতাকাঙ্খী ও বেনিফিসিয়ারিরা লতায়পাতায় জড়িত। দাতা-গ্রহীতা মিলিয়ে তাদের একটা নেটওয়ার্ক সবখানেই। যশোরের ছাগলের ঢুসে এখন নানাদিক একাকার। কারো কারো জন্য ছাগলটি যমদূতের মতো। বেনজীর-মতিউরসহ আরো কতো জন ফেঁসে গেছেন এই ছাগলটার কারণে। 

বেনজীর, আজিজ, মতির পর এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের নামে-বেনামে থাকা সব স্থাবর সম্পত্তি জব্দ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ফয়সালসহ ১৪ জনের ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ছয় কোটি ৯৬ লাখ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। পাশাপাশি ফয়সালসহ সাতজনের নামে থাকা ১৫টি সঞ্চয়পত্রে থাকা দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। 

এর আগে, ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর এনবিআরের সদস্য মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি ছাড়াও ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। 

এ ঘটনায় এরইমধ্যে মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানদের আটটি ব্যাংক এবং বিও হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ। এখন জব্দ করা হলো ফয়সালের স্ত্রী আফসানাসহ চারজনের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ। ছাগলটা ছুঁতা হলেও দুর্নীতিবাজ সনাক্তের ফ্রন্টলাইনার এবার সাংবাদিকরা। 

এ লড়াইয়ে তার সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র কেউ নেই। জনগণ গ্যালারিতে, হাতে তালি এবং টমেটো নিয়ে। প্রতিপক্ষে প্রকাশ্যে অস্ত্রসজ্জিত বিপুল পদাতিক, আড়ালে কমব্যাট ড্রেসে স্ট্রাইকিং ফোর্স। আছে মিলিশিয়া, রিজার্ভ ফোর্স, অনতিদূরে পরাশক্তি। এ কারণে সাংবাদিকদের পেয়ে বসেছেন সবাই। দেশের সমান্তরালে তা প্রবাসেও। দেশে পুলিশের কাছে সাংবাদিকরা অসহ্য। আর প্রবাসে চক্ষুশূল পুলিশ হত্যার আসামীর কাছে। 

সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রবাসী সাংবাদিকরা মার খেয়েছেন পুলিশ হত্যাসহ নানা অপকের্মর হোতা বহুল আলোচিত-বিতর্কিত আরাভ খান।  সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন’সহ কমিউনিটি ব্যক্তিত্বরা তা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন। পুলিশ হত্যা মামলার আসামী আরাভ খানের প্রবাসে সাংবাদিকদের ওপর তাফালিংয়ের সমান্তরাল সময়টাতে দেশে পুলিশও সাংবাদিকদের ওপর চরম ক্ষিপ্ত। 

পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন চায় সাংবাদিকরা যেন তাদের দুর্নীতি এবং বিত্তবৈভব নিয়ে কোনো তথ্য না দেন। সাবেক আইজিপি বেনজীর, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ডিআইজি জামিল হাসানসহ কয়েক পুলিশ কর্মকর্তার আলাদীনের চেরাগ হয়ে ওঠার কাহিনী প্রকাশে তারা ক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের ওপর। তা হজম করতে না পেরে বিবৃতিও দিয়ে বসেছে পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন। শাসিয়েছেও। বলেছে, যেন পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে এমন তথ্য পরিবেশন না হয়।

পুলিশ এসোসিয়েশনের এমন বিবৃতি ও মতিগতিতে মনক্ষুণ্ণ সাংবাদিকদের এসোসিয়েশন। গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে দেশের কিছু ক্ষমতাধর বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তার বিপুল ও অস্বাভাবিক সম্পদের বিবরণী সংবাদ করা হয়নি। দায়িত্বশীল সাংবাদিকরা প্রাপ্ত তথ্য, দলিল যাচাই বাছাই করে, প্রমাণযোগ্য বিষয়গুলোই প্রকাশ করছেন। 

এ নিয়ে কারো কারো প্রতিক্রিয়ার ভাষা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি হুমকি। পুলিশ এসোসিয়েশনের বিবৃতিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত চাওয়া হলো না। দুর্নীতিবাজদের বিচারও চাইলেন না বেনজীর-আসাদ সম্প্রদায়ের কর্মকর্তারা। উল্টো গণমাধ্যমকে ধমক দিলেন। এরই মাঝে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও একটা সাবধানতা দেয়া হয়েছে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য। বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা নষ্ট হয়, এমন সংবাদ প্রকাশে সতর্ক হতে। গত ক’দিন প্রকাশিত সংবাদগুলোর কোনোটিই পুলিশ বাহিনী নিয়ে নয়। এগুলোতে কেবল পুলিশ কর্মকর্তাদের কাণ্ডকীর্তি। কিন্তু, পুলিশ এসোসিয়েশন ক্ষেপে গিয়ে প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ নিয়েছে। পুলিশ বাহিনী ও নিজেদেরও ঠাকুর ঘরে কে? কলা খাইনার-দশায় নিয়ে গেছে।

কোন কর্মকর্তা দুর্নীতি করলে এটি তার  বিষয়, কোন বাহিনীর বিষয় নয় মোটেই। কিন্তু, দুর্নীতিবাজ ও তাদের সাঙ্গাতরা চাতুর্যপূর্ণভাবে গোটা বাহিনীকে সামনে নিয়ে আসছেন। তারওপর সংবাদের ব্যাকরণ শেখানোর কাজে পা বাড়িয়েছেন। এভাবে এগোলে কবে-কখন কারওয়ানবাজার, ঠাটারি বাজারের আলু-পেঁয়াজের দাম ঠিক করা ব্যবসায়ীরাও সংবাদ ও সাংবাদিকের সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার অভিযানে নেমে বসেন কে জানে! 

অথবা দুর্নীতির কোনো সংবাদই দেয়া যাবে না- এমন আইন করার চিন্তা জাগার মগজও এদেশে আছে। দুর্নীতিবাজ শ্রেণির জন্য দেশের –সমাজের অন্যতম নিরীহ জীব সাংবাদিকদের হয়রান-হুমকি, দরকার মনে করলে গায়ে হাত তোলাও কোনো বিষয় নয়। ক্রমেই দুর্নীতিবাজ-লুটেরাদের কমন শত্রু হয়ে পড়েছে সাংবাদিকরা। তাদেরকে পুলিশ শত্রু  ভাবে। পুলিশ হত্যাকারী আরাভ খানরাও তাই ভাবে। গত ক’দিন গণমাধ্যমে নাম আসতে থাকা দুর্নীতিবাজ বেনজীর, আসাদ, মতিউরসহ বিভিন্ন মিয়ারা উচ্চশিক্ষিত । নামের সঙ্গে ডক্টরেটও আছে কারো কারো। সংখ্যায় তারা অনেক। দেশে থাকাকালীন এদের প্রভাব, বলয়ের ফলে এরা ধরা-ছোয়ার উর্ধ্বে থাকে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তসহ সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকলে এরা সপরিবারে উড়াল দেয়। এটাই স্বাভাবিক চিত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে। 

চোররা কেবল সমাদৃত- সম্মানিত নয়; নানা সূচকে দয়াবান, মহোদয়ও। তাদের চুরি দেখেও না পারতে তাদের কেউ চটায় না। সমীহ করে। চুরি করে চোর-দুর্নীতিবাজ শ্রেণি দিব্যি শিনা টান করে চলে। বড় বড় কথাও বলে। এই চোরদের অনেক হিতাকাঙ্খীও। এবার ঘটনাচক্রে তাদের গা ঢাকা দেয়ার সময়ও এর প্রমান মিলছে। কী চমৎকারভাবে চম্পট দিচ্ছে চোরেরা। নইলে চোরগুলো  বিমানে উঠে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে কিভাবে? মাথা ন্যাড়া করে স্থল পথেই বা পালায় কিভাবে? চোরদের স্ত্রী-সন্তানরাও হয় বেশ সমঝদার। কয়েকটা বিয়ে করলেও স্ত্রীরা চেতেন না। বরং মিলেমিশে চুরি-চামারিতে শরীক হন। বেনজীরের স্ত্রী-মেয়ে বা ছাগলকাণ্ডের মতিউরের ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীদের এই সম্প্রীতির গুণ বিশ্লেষণ করার মতো। মতিউর ছেলেটাকে অস্বীকার করার পরও ছেলেটা বেয়াদবি করেনি। বাবাকে বলেনি, তুমি এতো এতো চুরি-চোট্টামি করেছো আমি কখনো অস্বীকার করেছি তোমাকে? অথবা ক্ষেপে গিয়ে বাবার অনেক কিছু কি ফাঁস করে দেয়নি।

চোর- দুর্নীতিবাজরা বেশ দানবীর-সমাজদারও। মসজিদ-মন্দিরে দান খয়রাত, সদকা-জাকাতে উদার হাত তাদের। স্ত্রী, সন্তান এমনকি বান্ধবীদেরও অকাতরে ধন, সম্পদ বিলান। বেশী স্ত্রী-বান্ধবীতে তাদের রিজিকও যেন বেড়ে যায়। সবাই মিলে তাদের টাকার বস্তা আগলে রাখে। সুলতান সুলেমান, সম্রাট শাহজাহান, ঈসা খাঁ, বিল ক্লিনটনরাও করেছেন। মতিউর-বেনজীর- পিকে হালদাররা সেই সম্প্রদায়েরই। তাদের জন্য গোপনেও দোয়া করেন অনেকে। তাদের যে কোনো কৃতকর্মের পক্ষে সাফাই গাওয়া লোকের অভাব হয় না। এটাই বাস্তব। সম্পদহীনতায় ভালোবাসাও দৌঁড়ে পালায়। দীর্ঘদিনের সহকর্মীরাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ বেনজীর-আসাদ মিয়াদের জন্য কতো আন্তরিক তাদের সহকর্মীরা। তারা এসোসিয়েশন থেকে বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, সাংবাদিকরা যেন পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করে। মন্ত্রীরাও বলছেন, নিরীহ কাউকে যেন দুর্নীতিবাজ বলা না হয়। এমন সাফাই ও দোয়ার হাত সাংবাদিক বা অন্য কারো মাথায় থাকে না। 

লেখক: . ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বাংলাপোস্ট ও কলামিস্ট
ই-মেইল [email protected]

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন: