• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

উন্নয়নযজ্ঞের সঙ্গে বৃক্ষরোপণও হোক বাধ্যতামূলক

প্রকাশিত: ২০:১১, ৩০ জুন ২০২৪

ফন্ট সাইজ
উন্নয়নযজ্ঞের সঙ্গে বৃক্ষরোপণও হোক বাধ্যতামূলক

অপরিকল্পিত নগরায়ন-শহরায়ণের কারণে বিগত কয়েক দশকে রাজধানী ঢাকায় বিপুল সংখ্যক গাছ কাটা পড়েছে। যত্রতত্র ভবন নির্মান, বড় বড় ইমারত, রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর কারণে পার্ক-উদ্যানসহ অনেক গাছ ধ্বংস হয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা চলমান রাখতেই হয়তো গাছ নিয়ে ভাবনার সময় হয়নি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু, এই মৌসুমে যখন তাপমাত্রা সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে, তখনই টনক নড়েছে সবার। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের মতো কাজেও হাত দিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু, যে তাপমাত্রা বছরের পর বছর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা-কি হুট করেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ বিরূপ আকার ধারণ করছে। ঘূর্ণিঝড়, শীলাপাত, দাবানল, ভূমিকম্প, বন্যা দেখা দিচ্ছে স্থানে স্থানে। বৃক্ষনিধনের ফলে গোটা পৃথিবী উষ্ণতর হচ্ছে। শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধিই নয়, শীতের মৌসুমেও পারদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একদা সবুজ বৃক্ষে ভরে থাকা পৃথিবী থেকে দিনে দিনে গাছ উজাড় হচ্ছে। অথচ, যে পরিমান গাছ রোপণ করা উচিত তা হচ্ছে না। 

বিপুল বনাঞ্চল দাবানলে পুড়ে যাচ্ছে রাতারাতি। কিন্তু, সেখানে গাছ রোপণ করলেই তা মুহূর্তে বেড়ে ওঠে না। বছরের পর বছর সময় নিয়ে গড়ে ওঠা বনভূমি যখন দাবানলে পুড়ে যায় তখন এর প্রভাব পড়ে বিশ্বজুড়ে। এই মৌসুমে ব্যাপকহারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এর মধ্যে অন্যতম।
অতিরিক্ত গরমের প্রভাব যে শুধু বাংলাদেশেই পড়েছে বিষয়টি তেমন নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর প্রভাব দেখা গেছে। কলকাতায়ও তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আমেরিকান-ইউরোপিয়ান-আফ্রিকান দেশগুলোরও একই পরিস্থিতি। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং গরমে স্বস্তি মিলছে না কোথাও। পরিবেশ যে বৃক্ষনিধনের জের তুলছে তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সৌদি আরব, দুবাইয়ের মতো আরব দেশও বন্যায় ডুবে যাচ্ছে, যা কখনো দেখা যায়নি।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমান গাছ উধাও হয়েছে সে তথ্য রীতিমতো ভয়ংকর। একটি দেশের পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পরিমান বনাঞ্চল থাকা দরকার তার ধারে-কাছেও নেই বাংলাদেশ। মোট আয়তনের তুলনায় ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক বছর আগেই বাংলাদেশে এই সংখ্যা ছিল ১৬ শতাংশ যা কমেছে বটে। বলতেই হয়, বেশ কয়েক বছর যাবৎ ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞের কারণেই নির্বিচারে মারা পড়েছে বিপুল সংখ্যক গাছ এবং বনভূমি। অথচ, সে তুলনা বৃক্ষরোপণের বড় উদাহরণ তেমন চোখে পড়ে না। 

পরিবেশবাদী সামাজিক সংগঠনগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে সভা-সেমিনার করেও কূল কিনারা পাচ্ছে না। অনেকে ধারাবাহিকভাবে গাছ লাগিয়েই চলেছে। কিন্তু, রাতারাতি তো আর সেসব গাছ বড় হওয়ার সুযোগ নেই। আর তাই, অনেক গাছ রোপণ করে সেগুলোর সুষ্ঠু পরিচর্যা নিয়মিত রাখতে হবে। যতদিন না সেগুলো বড় হচ্ছে তার দিকে নজর রাখতে হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা অনেক নিচে নেমে আসা; উভয়ই বৃক্ষ তথা অক্সিজেন, কার্বন-ডাই অক্সাইডের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর তাই, একমাত্র বিপুল পরিমান গাছ রোপণ এবং তার পরিচর্যা করলেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে পরিবেশ-প্রকৃতি।

আমরা দেখেছি, দেশজুড়ে রাস্তাঘাট উন্নয়ন-সম্পসারণের কাজে পাশে থাকা বড় বড় গাছগুলো কাটা হয়েছে। যে স্থানে গাছগুলো ছিল সে জায়গা দখলে নিয়ে রাস্তা বা ইমারত তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, ওইসব এলাকায় গাছ রোপণের সুযোগ থাকছে না। যে কারণে বৃক্ষরোপণের নতুন স্থান খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। দুষ্কর হচ্ছে- জায়গাও সীমিত, বিকল্প খোঁজাও বাঞ্ছনীয়। 

অসুবিধা জনসংখ্যাতেও। জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৮ কোটির কিছু বেশি হলেও বিপুল আবাদী জমি এবং বনাঞ্চল উজাড় করে সেখানে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। বছর বছর অনেক বৃক্ষসমৃদ্ধ পাহাড়ও সাবাড় হয়েছে। স্বীকার করতেই হবে, জায়গা সংকটের কারণেই মূলত গাছ রোপণ ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

তাপমাত্রা তথা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় বনাঞ্চল বৃদ্ধি। সচেতন মানুষ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবলেও সকলেই তেমন নয়। অনেক জানাশোনা মানুষও এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করেন না। জমির গাছ দমন করে আলিশান ভবন তৈরির অনেক নজির রয়েছে যা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়েছে। মাত্র ২২ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে কোটি মানুষের বাস। যে কারণে রাজধানীতে গাছ রোপণের জায়গা নেই বললেই চলে। অনিয়ন্ত্রিত এই শহরে বৃক্ষরোপণ করলেও তেমন কাজে আসে না। নিয়মিত পরিচর্যা এবং সচেতন মানুষের অভাবে অনেক গাছ বেড়ে ওঠার আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অনেক সময় কর্তৃপক্ষও দায়সারা ভাব দেখায়, শহর নিয়ন্ত্রণ করা হয় না মোটেও। এতো কিছু উপেক্ষা করেও সিটি কর্পোরেশন বছর বছর বিপুল গাছ রোপণ করে।

আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও বড় বড় সেমিনার করে দেশে দেশে নির্দেশনা দিচ্ছে বনাঞ্চল বৃদ্ধির। ছোট দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তাও করা হচ্ছে। কপ’র সঙ্গে যুক্ত দেশগুলো সম্মেলন করে নিজেরা উদ্যোগী হচ্ছে, বিশ্ববাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে পরিবেশের বিরূপ পরিস্থিতি নিয়ে। কোমড়ে দড়ি বেধে নেমেছে অনেক দেশ। কিন্তু, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কোন একটি দেশ বা এক ব্যক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া কোনভাবেই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।

এখন তো শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যার মৌসুমও এসেছে। কয়েক বছর ধরে বন্যার তেমন প্রভাব দেখা যায়নি, এবারের অবস্থা তেমন নয়। যে কোন সময় দেশজুড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি দেখা দিতে পারে। কিন্তু, এভাবেই কি চলবে? ভবিষ্যত অনিশ্চিত। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। পর্বতের বরফও গলছে। মৌসুমের যে কোন সময় বন্যায় দেশের বিপুল অংশ তলিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে অসময়ে পাহাড়ি ঢলে মাঠ, ঘাট, বসতবাড়ি, ফসল তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনাও রয়েছে।

বাস্তুসংস্থানের সব কিছু সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় প্রকৃতিকে শীতল রাখা। আর প্রকৃতি শীতল করার একমাত্র উপায় বৃক্ষরোপণ। ৫০ বছর আগে যখন দেশের মানুষের সংখ্যা সাড়ে সাত কোটি ছিল, তখন তো এমন পরিস্থিতি ছিল না। শুধু বাংলাদেশ নয়, তখন গোটা পৃথিবীই শীতল ছিল। এরপর প্রতি বছর অল্প অল্প করে গাছ কাটা হয়েছে। একদিনের কর্মে দেশে ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা আসেনি। বছরের পর বছর নিধনযজ্ঞের কারণেই এমনটি হয়েছে। 

এককালে আরব দেশে এমন গরমের ইতিহাস প্রচলিত ছিল, যা এখনো আছে। কিন্তু, সেই দেশে মরুভূমিতে বৃক্ষরোপণের প্রকল্প চালু করা হয়েছে। আরবের তাপমাত্রা অতিরিক্ত হলেও তারা যথেষ্ট সচেতন হয়ে তা মোকাবিলা করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে দিনের বেলাতেও কাজ বন্ধ রাখছে। নিজের দেশ রক্ষায় তারা নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। আমাদের দেশেও সরকারি-বেসরকারি সামাজিক সংগঠনগুলো বৃক্ষরোপণের দিকে জোর দিচ্ছে। কারণ, এখন থেকেই যদি পরিস্থিতি নিয়ে কাজ শুরু না করা হয় তাহলে এর ফল বিপরীত আকার ধারণ করবে। আগামী বছর হয়তো আবার নতুন রেকর্ড হবে। হিটস্ট্রোকে আরও মানুষ মারা পড়বে। বজ্রপাত, শীলাবৃষ্টির কারণে মৃত্যুসহ ফসলাদি-অবকাঠামোর ক্ষতি হবে। সব পক্ষ সচেতন না হলে এ সমস্যা বাড়তেই থাকবে।

আগেই বলা হয়েছে, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় বৃক্ষরোপণ এবং এর সংখ্যা বৃদ্ধি। এই বৃক্ষ যত বেশি রোপণ করা হবে প্রকৃতি তত শীতল হবে, নিয়ন্ত্রণে থাকবে, প্রাণীসকলের পক্ষে থাকবে। অন্যদিকে, যত বেশি পরিমান গাছ ধ্বংস করা হবে প্রকৃতি তত বিষণ্ন হবে, বিরূপ আকার ধারণ করবে। এতে মানুষসহ সকল প্রাণীরই বিপদ বাড়বে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মারা পড়বে মানুষ। নিস্তার পাবে না জীবজগৎ।

এখন রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা থেকে রক্ষা পেতে অনেকে ঘর থেকে বের হন না। অথচ, দিনমজুর শ্রেনীর মানুষ জীবন বাজি ধরে রাস্তায় নেমে কাজ করছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাইরে থাকা মানুষগুলো এতো গরমে কোথাও শস্তির নিশ্বাস নেওয়া সুযোগ পায় না। অচিরেই যে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, তা শতভাগ নিশ্চিত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে অপরিকল্পিত শহরায়ন, যত্রতত্র ইমারত নির্মান বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন বা বনাঞ্চলের ক্ষতি করা যাবে না, প্রয়োজনে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। এ বছর থেকেই যদি এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে আগামী বছর পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

এখন মৌসুম চলছে। দেশজুড়ে যত ফাঁকা এবং অনাবাদি জায়গা রয়েছে সেসকল স্থানে এ বছরই গাছ রোপণের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্ষার মৌসুমেই বিপুল গাছ রোপণ করে সেগুলো দেখাশোনার মাধ্যমে বড় করার ব্যবস্থা করতে হবে। একটি গাছ বড় হতে হয়তো ১০ বছর সময় লেগে যায়। আর তাই তেমন পরিকল্পনা করেই গাছগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। এ বছর লাগানো গাছগুলো আগামী বছর গিয়ে কিছুটা তো বড় হবেই। আর তখনই এর সুফল মিলতে শুরু করবে। বছর বছর একটু একটু করে গাছগুলোকে বড় করে তুলতে পারলে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে বেশি বেগ পোহাতে হবে না। কিন্তু, অনেক সময় লাগবে; এমন চিন্তা করে বসে থাকার সুযোগ নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর পরিবেশে গড়ে তুলতে হলে এখন থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পৃথিবী সবুজময় করে গোড়া তোলা গেলেই কেবল দেশ, বিশ্ব তথা মানবজাতির কল্যাণ হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)

বিভি/পিএইচ

মন্তব্য করুন: