মার্কিন নেতৃত্ব এক নম্বর থেকে দুই নম্বরের পথে যাত্রা করেছে
বিশ্বে নতুন লড়াই হবে ক্যাপিটাল কয়েন বনাম সোশ্যাল কয়েনের!

রেজা ঘটক
রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণ এবং মার্কিন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পশ্চিমা জোটগুলোর রাশিয়ার বিরুদ্ধে কয়েক হাজার নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতিকে 'শীতল যুদ্ধ–পরবর্তী যুগের' আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হিসেবে ধরা যায়।
রাশিয়ার এই যুদ্ধটি গোটা বিশ্বে নতুন একটি বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মঞ্চ তৈরি করেছে। গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন নতুন পরিবর্তনগুলো কি কি হতে পারে:
১. বিশ্ব অর্থনীতি কার্যত এখন দুইভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার পথে রওনা হয়েছে। বিশ্বের আর্থিক কাঠামোকে এখন যেখানে নিয়ন্ত্রণ করছে মার্কিন ও পশ্চিমা জোট। সেখানে এখন চীন ও রাশিয়া নতুন একটি বলয় তৈরি করছে।
প্রকৃত বাস্তবতা হলো অর্থনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরে গেছে। মার্কিন নেতৃত্ব এক নম্বর থেকে দুই নম্বরের পথে যাত্রা করেছে। বিশ্বের প্রধান আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা, বাণিজ্য ও আর্থিক প্রবাহ এবং নেতৃস্থানীয় ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো এখন কার্যত দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে।
ডলারভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রতিপক্ষ হিসেবে এখন চীনা মুদ্রাভিত্তিক উদীয়মান অর্থব্যবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে সমান্তরালভাবে চলবে এমন দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থা খুব শীঘ্রই চালু হবে বলে মনে হচ্ছে।
২. গোটা বিশ্ব এখন পাহাড় সমান ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে। রাশিয়াকে একঘরে রাখার পশ্চিমা জোটের খায়েস মোটেও পূর্ণ হবে না। কারণ দুর্বল শাসনব্যবস্থা আর ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত ইউক্রেনে পশ্চিমারা এখন বানের পানির মতো যে অস্ত্র পাঠাচ্ছে।
একসময় এই অস্ত্র আবার পশ্চিম দিকেই প্রবাহিত হবে। আর তা গোটা ইউরোপ জুড়েই অবাধ অপরাধ, মাদক পাচার ও সন্ত্রাস-সহিংসতাকে উসকে দেবে। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর এতোদিনের শান্তি বিনষ্ট করার কবর খুড়ে দিচ্ছে এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট।
কৌশলগত কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশিদিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ধরে রাখতে পারবে না। কারণ ইউরোপে আমেরিকা নতুন করে তেল-গ্যাস সরবরাহ করার যে কৌশল করতে যাচ্ছে, তা বরং ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই ভেঙ্গে দিতে পারে।
কারণ রাশিয়া ইউরোপে তেল-গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ইইউভুক্ত জোট থেকে অনেকে বেরিয়ে যাবে আর রাশিয়ার থেকে তেল-গ্যাস পাবার চেষ্টা চালাবে। তখন আর ডলার বিনিময়ে বেচাকেনা হবে না, তেল-গ্যাস বেচাকেনা হবে রুবেল বনাম নিজ নিজ দেশের মুদ্রার বিনিময়ে। যা গোটা বিশ্বে ডলারভিত্তিক বিনিময় প্রথাকে কার্যত ধ্বংস করে দেবে।
৩. রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সত্ত্বেও ইউরোপ রাশিয়ার অর্থনীতির মূল ভিত্তি তেল ও গ্যাস রপ্তানিকে সচল রাখতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ ইউরোপ যদি রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেয় তাহলে জ্বালানির দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে। আর তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি ভোগ করবে ইউরোপ।
যে কারণে পশ্চিমাদের হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি কোনোদিন বন্ধ হবে না। রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইউরোপের দীর্ঘকালের নির্ভরতার কারণেই ইউরোপ একসময় রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য করতে আগ্রহ দেখাবে। তখন রাশিয়া ডলারের পরিবর্তে রুবেলের বিনিময়ে তেল-গ্যাস কিনতে ইউরোপকে বাধ্য করতে পারে।
৪. ইতোমধ্যে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে রুপির বিনিময়ে তেল কিনছে। সৌদি আরব চীনের কাছে চীনা মুদ্রা রেনমিনবিতে তেল বিক্রির কথা বিবেচনা করছে। এসব উদ্যোগ মার্কিন ডলারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিনষ্ট করার সূচনাপর্ব।
এই সুযোগে ডলারভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রতিপক্ষ হিসেবে চীনা মুদ্রাভিত্তিক উদীয়মান অর্থব্যবস্থা গোটা বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক সমীকরণ গড়ে দেবে।
৫. নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গোটা বিশ্বে দুই ধরনের মুদ্রা জনপ্রিয়তা পাবে। যার একটি হবে ক্যাপিটালিস্ট কয়েন ডলার আর অন্যটি হবে স্যোশালিস্ট কয়েন রুবেল/রেনমিনবি বা নতুন কোনো মুদ্রা।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুটি দেশ যখন বাণিজ্য করবে তখন তারা নিজেদের নিজস্ব মুদ্রায় বেচাকেনা করাকে প্রথমে অগ্রাধিকার দেবে। যেমন বাংলাদেশ ভারতের সাথে টাকা ও রুপির বিনিময়ে বাণিজ্য চালু করবে।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হিসেবে দুটি দেশ বাণিজ্য করার সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ক্যাপিটালিস্ট কয়েন ডলার অথবা সোশ্যালিস্ট কয়েন রুবেল/রেনমিনবি যে কোনো একটিতে অর্থ বিনিময় করবে।
বর্তমানে বিপুল তেজস্বী ডলারকে আর গণণায় রাখবে না। অর্থ্যাৎ ডলারের একক আধিপত্য ধ্বংস হবার রাস্তা প্রায় তৈরি হয়ে গেছে।
রাশিয়াকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান। শ্বেতভাল্লুককে তার ইচ্ছে মত বরফে থাকতে দাও। নতুবা লোকালয়ে আসতে বাধ্য হলে সে সবকিছু তছনছ করে দেবে।
এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট রাশিয়াকে যেভাবে ক্ষেপিয়ে তুলছে তার পরিণতি গোটা বিশ্ববাসীকেই ভোগ করতে হবে। রাশিয়াকে একঘরে রাখার পশ্চিমা কৌশল পৃথিবীতে কার্যকর হবে না বরং উল্টো তা গোটা ইউরোপজুড়েই নতুনভাবে সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটাবে।
রেজা ঘটক : কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
মন্তব্য করুন: