আমার বাবা : সাধারণ, অতিসাধারণ

১৯৮৯-৯০ সালের কথা। আমি বুয়েটে পড়ি। আমার ক্যালকুলেটর নস্ট হয়ে গেছে। সে সময় প্রতিমাসে আমাকে হাত খরচ বাবদ বাবা ১৫০০ টাকা করে পাঠান। বাবা থাকেন সিলেটে। আমি চিঠি লিখলাম- বাবা, আমার ক্যালকুলেটরের জন্য ৭০০ টাকা পাঠান। কয়েকদিন পর আমি একটা চেক পেলাম। "তোমার ক্যালকুলেটর কেনার জন্য ৭০০ টাকা পাঠালাম।"
এর কয়েকদিন পর আমি মাসের টাকাটা পেলাম। বাবা লিখেছেন - এই মাসে তোমার খরচের জন্য ১০০০/- টাকা পাঠালাম।"
আমি হতভম্ব হয়ে চেকের অংকের দিকে তাকালাম। বুঝলাম -এই মাসে আমাকে দ্বিগুন হাটতে হবে, যতটা সম্ভব দেখা সাক্ষাতের নাম করে সন্ধ্যা বেলায় আত্মীয় স্বজনের বাসায় যেতে হবে এবং মাসের শেষের দিকে সকালের নাস্তাকে ট্রিকসে ফেলতে হবে!
সেই ক্যালকুলেটর কেনার কী হয়েছিল সেটা না হয় নাই বলি।
কিন্তু দ্বিতীয় চেক পেয়ে মন খারাপ হয়েছিল অনেকটা। কারণ যে ছেলে ১৫০০ টাকায় চলতে পারে না, টিউশনি আর পত্রিকায় লিখতে হয় সে কেমনে ১০০০-এ চলবে!
অনেক পরে, যখন সীমিত টাকায় সংসার চালনা শুরু করি তখনই টের পাই বাবা কেন এমনটা করেছিলেন। সে সময় কোন মাসে অতিরিক্ত ৭০০ টাকা আমার পেছনে খরচ করার মত সামর্থ হয়তো বাবার ছিল না। সিলেট ও চট্টগ্রামের দুইটা এষ্টাবলিশমেন্ট ছাড়াও নিজের ভাই-বোনদেরও অনেক কিছু ওনার করা লাগতো। তাই তিনি আমাকে মিতব্যয়ী হওয়ার একটা তরিকা দেখিয়েছেন।
আজকে যখন লোকে আমাকে বলে কীভাবে এতো কম টাকায় গণিত উৎসব বা অন্যান্য আয়োজনগুলো হয় তখন আমি হাসি। আর উপরে তাকাই।
আমার বাবা, আবুল ফজল মোহাম্মমদ এজহারুল হক, কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করে। দাদার শখ ছিল বাবা ডাক্তার হবেন। কিন্তু চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারে কিছুদিন সায়েন্স পড়ার পর বাবা রণে ভঙ্গ দেন। চলে আসেন আর্টসে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামের ইতিহাসে। থাকতেন ফজলুল হক হলে। পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে তখন দেশে নানা উত্তেজনা। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে বলে দ্রুত পাস করে চট্টগ্রামে ফেরৎ যান। দাদার মতো শিক্ষকতা বেছে নেন। যদিও আল্লাহর ইচ্ছা ছিল ভিন্ন।
১৯৫৩ সালে আবুল কাসেম খান ন্যাশনাল কটন মিল চালু করতে গিয়ে টের পান পূর্ব বাংলার উদ্যোক্তাদের টাকা দেওয়ার কোন ব্যাংক নাই। তখন থেকে তিনি ভাবতে থাকেন কেমন করে ব্যাংক করা যায়। নিজে যেমন শ্বশুর আবদুল বারী চৌধুরীর ছায়া পেয়েছেন সেরকম নিজের জামাতা মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীকে পাশে পেয়ে ব্যাংক বানানোর তোরজোর করেন। ১৯৫৯ সালে, যে বছরে রুমানিয়াতে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হয়, সে বছরই প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ব্যাংক –ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক (এখন পূবালী ব্যাংক)। সেটি চালানোর জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসেন ব্যাংকার মোহাম্মদ খালেদকে।
১৯৬৩ সালে রাউজানের ফিল্ড মার্শাল নছিমা খাতুন মানবতার সেবক ডা এম এ হাসেমকে রাজি করান তার ন'কন্যাকে নিজের পুত্রবধু বানাতে। বিয়ের পর খালেদ মামা বাবাকে মাস্টারি ছেড়ে ব্যাংকার হতে পরামর্শ দেন। বাবাও রাজি হোন। বাবা চলে আসেন ইন্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে। “ইসলামের ইতিহাস পড়ে ব্যাংকে কেমন করে কাজ করলেন” আমার এই প্রশ্নের জবাবে বাবা বলতেন – চাকরিতে ঢোকার পর পরই ট্রেনিং দিলো। তারপর তো জার্মানীতে গিয়ে এক বছরের একটা ব্যাংকিং ডিপ্লোমা করে এসেছি”।
কাজে বাবা সেখানেই ভাল করেন। ১৯৯১ সালে রিটায়ার করার অনেক পরেও যখন বাবার কোন কলিগের সঙ্গে দেখা হতো, তারা বলতেন বাবা কেমন ট্রাবলশুটার ছিলেন। সেজন্য চাকরির শেষ জীবনে তাঁকে সব গোলমেলে অঞ্চলে পাঠানো হত। বাবার কাজ ছিল ঐ জোনকে ঠিক করে আর একটা জোনে যাওয়া। কুমিল্লা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ হয়ে সিলেটের এসাইনমেন্ট শেষ হয়ে যাবার পর বাবা যখন রিটায়ারের আগে চাটগাঁ ফিরতে চাইলেন তখন তাঁকে বলা হল অন্য একটা জোনে যেতে। বাবা তখন রিটায়ারমেন্টের অপশন চান যদিও তার চাকরি আরো কয়েক মাস ছিল।
বাবা ১৯৯১-এর শেষ রিটায়ারমেন্টো যাবেন এটা আমি জানতাম। আরও জানতাম ১৯৮৮ সালে আমার বুয়েট জীবন শেষ হবে। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদের পাল্লায় পরে ১৯৯১ সালের শুরুতেও আমার পাস করা হয়নি। আরও কয়েকমাস পরে সেটা হয়েছে।
ব্যাংকিং-এর কাজটার পাশাপাশি বাবা আর একটা কাজ করতেন, পাবলিক রিলেশন। চট্টগ্রামের এমন কোন পরিচিত লোক তাঁর ছিল না যার জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা তিনি করেন নাই। বেশিরভাগই টাকা পয়সার কাজ নয়। যেমন - একজনের ছেলের বউ, পড়াশোনায় খুব ভাল, স্কলার। বাসায় বসে আছে। বাবা তাকে উদ্বুত্ত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়ে দিলেন। ও মেয়ে এখন প্রফেসর হয়েছে!
আবার বাবার একটা কাজ ছিল কাঞ্চন মামা’র বক্তৃতার খসড়া লিখে দেওয়া। হিস্ট্রি রিপিটস!
আজ থেকে ৯ বছর আগে, ঠিক এদিনে বাবা চলে যান।
সেবছর ৩ তারিখে আমি বাবাকে দেখে ঢাকায় ফিরে আসি। ৪ তারিখ রাতে ছোট ভাই জানায় বাবা রুবাই-বিদুষীকে দেখতে চেয়েছেন। ৫ তারিখ আমি রুবাইকে নিয়ে রওনা দেই। সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। কথা ছিল পরের দিন বিদুষী আর তার মা যাবে। রাতে বাড়িতে পৌছেই রুবাই তার দাদার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। বাবা তখন তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কথা বলেন। আমি, রুবাই, ফাহাদ, আমার ভাই - আমরা ওনার পাশে বসা ছিলাম। আমি একটু ঘুমাতে গেলাম। রুবাইকে বললাম দাদার কাছে থাক। সকালে আমি উঠলে তুই ঘুমাতে যাস। ভোর রাতের দিকে ওদের চিৎকারে দৌড় দিয়ে বাবার রুমে গেলাম। ফাহাদ নানান ভাবে চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে বললো - মামা, চলে গেছেন।
সেদিন বিকেলে বাবাকে রেখে আসলাম রাউজানে আমাদের গ্রামের কবরস্থানে।
মারা যাবার পর আশেপাশের এতিমখানার পরিচালকরা এসে জানালেন বাবা ঐ এতিমখানাতে নিয়মিত খরচ দিতেন, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খোঁজ নিতেন এবং নিয়মিত সেখানে যেতেন। যদিও আমরা সেটা কখনো জানতে পারিনি! পরে এরকম আরো অনেক খোঁজ আমরা পেয়েছি।
বাবা কথা বলতে ভালবাসতেন। প্রতিদিন নিয়ম করে আত্মীয়স্বজনের খোঁজে বের হতেন নাহলে ফোন করতেন। ১৯৯৮ সালে বাবাকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাই। সেখানে বাবার বাইপাস হার্ট সার্জারি করেন ডা. দেবী শেঠী। বাবার সঙ্গে ডাক্তারের খাতিরের একটা উদাহরণ দেই।
ব্যাঙ্গালোর থেকে দেশে ফেরার কয়েকবছর পরে বাবা একদিন আমাকে ফোন করে জানায় যে দেবী শেঠী ঢাকায় আসবেন। আমি যেন তার জন্য একটা এপয়েন্টমেন্ট নেই। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম আর কোন এপয়েন্টমেন্ট নাই।
কিন্তু বাবা ঢাকায় চলে এলেন। বললেন উনি কোথায় আসবে খোঁজ নেয় আর আমাকে নিয়ে এমন জায়গায় দাঁড়াবি যেন উনি গাড়ি থেকে নেমে আমাকে দেখতে পায়।
নির্ধারিত দিনে সেন্ট্রাল হসপিটালে আগেভাগে চলে গেলাম। তারপর এমনভাবে দাড়ালাম যেন গাড়ি থেকে নেমে ডাক্তার বাবাকে দেখতে পান। আমাদের সামনে একটা দড়ি দেওয়া হলো। ভলান্টিয়াররা দুইদিক ধরে রাখলেন।
ডা দেবী শেঠি গাড়ি থেকে নামলেন। নেমেই বাবাকে দেখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত হাসিটি দিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে গেলেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন বাবার দিকে - হাও আর ইয়ু, মি. হক!
ভলান্টিয়াররা সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কে জানি দৌড়ে এসে আমাদের সামনে থেকে দড়ি সরিয়ে নিল। দেবী শেঠি বাবার হাত ধরে রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - কাম অন। তারপর আমাদের নিয়ে হাসপাতালে ঢুকে তার জন্য নির্ধারিত রুমে নিয়ে গেলেন।
এর মধ্যে একজন আয়োজক আমার কাছে জানতে চাইলো উনি কে?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম - মি হক।
দেবী শেঠী আয়োজকদের বললেন তিনি প্রথমেই বাবার চেকআপ করবেন। তারপর অন্যদের। এবং সেবার তিনি আয়োজকদের ডেকে আমার ফোন নম্বর নিতে বললেন। এরপর থেকে উনি যতোবার আসবেন আমাকে যেন খবর দেওয়া হয়। উনি মি. হকের সঙ্গে দেখা করে যাবেন।
বাবা এমনই ছিলেন। সাধারণ, অতিসাধারণ।
সারাজীবনই আমি তাই চেষ্টা করি বাবার মতো সাধারণ একজন মানুষ হতে।
ভালো থেকো বাবা।
জগতের সব বাবা ভাল থাকুন।
মুনির হাসান : হেড অব ইয়ুথ প্রোগ্রাম, প্রথম আলো
মন্তব্য করুন: