• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১ মে ২০২২

ফন্ট সাইজ
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা

“এমন সময় আসবে যখন কবরের অভ্যন্তরে শায়িত আমাদের নিশ্চুপতা জ্বালাময়ী বক্তৃতার চেয়ে বাক্সময় হবে এবং তা শ্রমিক শ্রেণির বিজয় লাভের শেষ সংগ্রাম পর্যন্ত লড়াইয়ে প্রেরণা যোগাবে।  এবং শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস চীর স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর সেদিনের সেই ভবিষ্যৎদ্বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যর্থ হয়নি,  তাদের সেই আত্মদান। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা এক স্বরণীয় অধ্যায়। তাঁদেরই আত্মদানে প্রতিষ্ঠিত (মহান মে দিবস) পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে। মে দিবস- আজ তাই হাজার হাজার শ্রমিকের পায়ে চলা মিছিলে কথা, আপসহীন সংগ্রামের কথা। মে দিবস- দুনিয়ার শ্রমিকের এক হওয়ার ব্রত। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন।  মে দিবসের অর্থ শ্রমজীবী মানুষের উৎসবের দিন,  জাগরণের গান, সংগ্রামে ঐক্য ও গভীর প্রেরণা।  মে দিবস- শোষণ মুক্তির অঙ্গীকার,  ধনকুবেরের ত্রাণ, দিন বদলের শপথ । 

আন্তর্জাতিক মে দিবস

১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক দৈনিক আট ঘন্টা কাজের সময় নিধারণ ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে সর্বাত্মক ধর্মঘট শুরু করে।  ব্যাপক আন্দোলনের চুড়ান্ত রুপ লাভ করে ৩ ও ৪ মে। কিন্তু আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করার জন্য পুলিশ গুলি চালায় এবং ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। সেই সঙ্গে বহু শ্রমিক আহত হয়।  গ্রেফতার হয় অগণিত শ্রমিক।  গ্রেফতারকৃত শ্রমিকদের মধ্যে ৬ জনকে পরে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।  জেলখানায় বন্দী অবস্থায় আত্মহনন করেন এক শ্রমিক নেতা ।  শ্রমিক আন্দোলনের এই গৌরবময় অধ্যায়কে স্বরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বের সকল দেশেই মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে মহান মে দিবস-। 

মে রানির রুপকথা

মে দিবস- ছিল একদিন মে রানির রুপকথার অন্দরমহলে ঘুমিয়ে।  আজকের সংগ্রামী তাৎপর্য ছিল তার অজানা।  ইউরোপে দুর্জয় শীতের প্রথম তুষারপাত শুরু করেছে ।  গাছে গাছে নতুন পাতা দিকে দিকে ফুলের বাহার।  পাখির গান। মাঠেঘাটে কর্মের জোয়ার।  শীতবৃদ্ধ বিদায় নিয়েছে।  এসেছে তরুণ বসন্ত।  তখনই মে রানির ঘুম ভাঙতো। ১ মে হতো তার উৎসব।  রোপণ করা হত মে বৃক্ষ। তাকে সাজানো হত বিচিত্র পুষপহারে।  তারপর সেই মে রানিকে ঘিরে শুরু হত নাচ - গানের উৎসব। কবিরা মে রানির কে নিয়ে লিখেছেন কবিতা।  দেশের রাজারানি - প্রজারাও মেতে উঠতেন উৎসবে। দিন বদলায়, বদলায় সমাজ ব্যবস্থা।  পাল্টে যায় শব্দের অর্থ।  মে রানির একদিন কোথায় হারিয়ে গেল।  উনবিংশ শতাব্দীর মেষভাগে এসে মে দিবসের অর্থ গেল বদলে।  মে দিবস- হল কাজের সময় হ্রাস ও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন। হল দুনিয়ার শ্রমিকদের সংহতি দিবস, পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামী শপথ।  শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন থেকেই উঠে এসেছে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মহান মে দিবস-।

ইসলামে শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আজ অবধি পৃথিবীতে যা কিছু গড়ে উঠেছে তা সবই শ্রমের ফল এবং শ্রমিকের কৃতিত্ব। ইসলাম শ্রমিক এবং শ্রমকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। একমাত্র ইসলাম ধর্মই শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে মূলনীতি ও বিধান প্রবর্তন করেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, সৌহার্দ ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর। শ্রমিক ও মালিক উভয়ের নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার অধিকার রয়েছে। উভয়কে বলা হয়েছে, নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শুধু শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বহু নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ পূর্ণ করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আর আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে’-(সুরা জুমুআহ, আয়াত ১০)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরেই হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব’-(তিরমিজি)। ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে তা সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দ্বারা অর্জন করা হয়’-(মুসলিম)।

ইসলামে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্যের বিলোপ করেছে। তবে শ্রেণিবৈষম্য বিলোপের নামে মালিক ও উদ্যোক্তার মেধা, শ্রম ও সামাজিক পদমর্যাদাকে অস্বীকার করেনি ইসলাম। চাপিয়ে দেয়নি নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থা। বরং তার ভেতর মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রমিকের প্রতি মমতা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না; যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’-(সুরা নাহল, আয়াত ৭১)। উল্লিখিত আয়াতে যেমন মালিকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়েছে, তেমনি তার অহংবোধ ও শ্রেণিবৈষম্যের ধারণার নিন্দা করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদের প্রকৃত মালিকানা ও তা অর্জন করতে পারা যে একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ সেটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে মনোযোগী হয়। 

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক। বর্তমানে মে দিবসের সম্মানার্থে বাংলাদেশেও ১ মে সরকারী ছুটির দিন। এদিন শ্রমিকরা মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করে মে দিবস। তারা তাদের পূর্বসূরীদের স্মরণে আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসে আয়োজন করে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচির। বাংলাদেশের শ্রমিকরা এদিন আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করে মহান মে দিবস।

ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আজকের শ্রমিক শ্রেণিকে আগলে রেখেছে। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা এখন শ্রমজীবীদের ভূষণ। ১৮৮৬ সালের রক্তঝরা সেই ১ মে এখন সবার কাছে অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রামের শপথ গ্রহণের দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। মে দিবসে সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী পরিবর্তন সূচনার অঙ্গিকারের প্রয়াস পায়।

পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সুতরাং শ্রম-ঘণ্টা তথা শ্রমিকের কাজের সময়সীমার ব্যাপারেও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কোনোমতেই অধিক পরিশ্রম বা অধিক সময়ের শ্রম কোনো শ্রমিকের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ইসলামসম্মত নয়। কোরআনে কারিমে মানুষকে চিত্রিত করা হয়েছে শ্রমের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য দিয়ে। ইরশাদ হচ্ছে- সুনিশ্চিতভাবে মানুষকে আমি শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি। এই শ্রমনির্ভরতা বা শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। সুতরাং শ্রম ও শ্রমিকের পেশাটি একটি সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। সে জন্য যে কোনো শ্রমকেই আমাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত এবং শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় সম্ভাব্য সব প্রচেষ্টাই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি-রাষ্ট্রের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হওয়া আবশ্যক।

লেখক:-: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক বাংলা পোস্ট ও প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান সৃজনশীল প্রকাশনা

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2