শেখ মুজিব: নায়ক নাকি একনায়ক? (ভিডিও)
৭ই মার্চ, ১৫ই আগস্টসহ বাতিল হয়েছে জাতীয় ৮টি দিবস। আর এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে উঠেছে নতুন বিতর্ক। ইতমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ মন্তব্য করেছেন শেখ মুজিব একা জাতির পিতা ছিলেন না। চলুন এক নজরে দেখে আসি ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কিছু অজানা ইতিহাস।
৭ই মার্চ কি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন?
গত ১৫ বছর ধরে দাবি করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। তবে বেশ কিছু সূত্র বলছেন ভিন্ন কথা! ৭ই মার্চের ভাষণ সরাসরি শোনা মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই স্বাক্ষ দিয়েছেন যে, শেখ মুজিব ভাষণ শেষ করেছেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে।
মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান রেন্টু তাঁর ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইতে লেখেন, সেদিন শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা করেও করলেন না। তিনি মূলত ৪টি দাবি তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তান সরকারের কাছে। যদি তাঁর এসব দাবি মেনে নেয়া হয়, তাহলে তিনি ভেবে দেখবেন তিনি এসেম্বলিতে বসবেন কি না।
রেন্টু লেখেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না করে একটুখানি বাকি রাখেন। তিনি কেন সেদিন সরাসরি ঘোষণা করলেন না তা নিয়ে এখনও রয়ে গেছে রহস্য। এমনকি রেন্টুর বিশ্লেষণে উঠে আসে, সেদিন যদি শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতেন, তাহলে ১২ হাজার মাইল দূর থেকে পাকিস্তান সেনা অভিযান পরিচালনা করার সুযোগই পেত না এবং কোন প্রকার রক্তপাত ছাড়াই দেশ স্বাধীন হতো।
২৫শে মার্চ রাতে শেখ মুজিব
২৫শে মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর নির্মম গণহত্যা চালায়, সে সময়ে শেখ মুজিবের ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের মেয়ে শারমিন আহমেদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা’ বইতে এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। বইয়ের ৪৫, ৪৬ নম্বর পৃষ্ঠায় শারমিন আহমেদ লেখেন, ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে নিতে তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর বাসায় যান। তাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো যদি পাকিস্তান সরকার সামরিক অভিযান করে, তাহলে তারা আত্মগোপনে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শেখ মুজিব আত্মগোপনে যেতে অস্বীকৃতি জানান, এবং সেচ্ছায় কারাবন্দি হওয়ার প্রস্তুতি নেন। শুধু তাই না, পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও একটি টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষর করেননি এবং মৌখিক ভাবেও ঘোষণা দেননি।
মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান রেন্টুর বইতেও একই রকম বিষয় উঠে আসে। তিনি লেখেন, ২৭ তারিখ সকালে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দুইটি ঘোষণা দেন। প্রথমবার তিনি নিজে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ঘোষণা দেন। যদিও শেখ মুজিব সে ঘোষণা দিতে আসলেও বলেছিলেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক।
স্বাধীনতা পরবর্তী শেখ মুজিব
মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি ফিরে আসেন দেশে। এর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। তবে ৭২ থেকে ৭৫ এর ইতিহাস আমাদের অনেকেরই অজানা। এ সময় আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ মুজিবের ঘনিষ্টজনদের বিরুদ্ধে উঠে সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রিতী ও দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার অভিযোগ।
নতুন প্রধানমন্ত্রী
১৯৭২ সালে যখন শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তিনি ভালো করেই জানতেন যে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতা নেই। আর তাই তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে সরিয়ে নিজেই বনে যান প্রধানমন্ত্রী। শারমিন আহমেদ তাঁর ‘তাজউদ্দিন আহমদ, নেতা ও পিতা’ বইয়ের ১০৪ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখেন, ৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বিশাল জনসভায় যখন শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছিলো তখন তিনি তাজউদ্দিন আহমদের কানে কানে বলেন, “তাজউদ্দিন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবো।” যে কথা সেই কাজ। মুজিব নগর সরকারের অস্থায় সংবিধানকে সরিয়ে দিয়ে ১১ তারিখ নতুন সংবিধান আইন জারি করে ১২ তারিখ তাজউদ্দিন আহমদকে সরিয়ে তিনি নিজে হয়ে উঠেন প্রধানমন্ত্রী।
গণপরিষদ সদস্য পদ বাতিল আদেশ ২৩/১৯৭২
১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান একটি আইন পাশ করেন, গণপরিষদ সদস্য পদ বাতিল আদেশ ২৩/১৯৭২। এই আইনের বলে তিনি যখন ইচ্ছা, যার ইচ্ছা সংসদ সদস্যপদ বাতিল করতে পারতেন। অর্থাৎ, সংসদে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই বাতিল হয়ে যেত তাঁর সংসদ সদস্য পদ। এই আইন পাশের মাত্র ৩ মাসের মধ্যেই বরখাস্ত করা হয় ৪৬ জন এমপিকে।
রক্ষীবাহিনী
৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে আরও একটি আইন পাশ করেন শেখ মুজিব, জাতীয় রক্ষীবাহিনী আইন। এই আইনের বলে তিনি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরও একটি স্বসস্ত্র বাহিনী নির্মাণ করেন যেটি কিনা সম্পূর্ণরূপে শেখ মুজিবের তত্বাবধায়নে চলতো। অভিযোগ উঠে, এই রক্ষীবাহিনীকে ব্যাবহার করে ঘটানো হতো বিচারবহির্ভূত গুম ও খুন। এমনকি এমন অভিযোগও উঠে যে শেখ মুজিব দেশের সেনাবাহিনী থেকেও রক্ষীবাহিনীকে বেশি সুযোগ সুবিধা দিতেন আর তাই সেনা সদস্যদের একটি বড় অংশের মনে জমছিলো তাঁর প্রতি বিদ্বেষ।
১৯৭৩ সালের নির্বাচন
১৯৭৩ সালের নির্বাচন ছিলো একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন। কারণ সদ্য স্বাধীন দেশে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে উঠেছিলো বিপুল কারচুপির অভিযোগ। শারমিন আহমদের লেখা ‘তাজউদ্দিন আহমদ, নেতা ও পিতা’ বইতে ৭৩ এর নির্বাচনের কারচুপির বিভিন্ন কথা উঠে আসে। এমনকি এই কারচুপিতে সরাসরি শেখ মুজিবের অংশগ্রহণের অভিযোগও উঠে আসে। আর এসব ব্যপারে তাঁর সাথে তাঁর ছেলে শেখ কামালও ছিলেন জড়িত। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী ছিলো জাসদ। আর জাসদের নেতারা যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তাই বহু নেতাকে অপহরণের ঘটনাও ঘটে। ভোলায় জাসদের এমনই এক শক্তিশালী নেতা ছিলেন ড. আজহার উদ্দিন। একই আসন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেন শেখ মুজিব। কিন্তু মনোনয়ন জমা দেয়ার দিন আওয়ামি লীগের কিছু লোক ড. আজহার উদ্দিনকে অপহরণ করেন। ফলে তিনি মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি আর সেই আসনে শেখ মুজিবকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এই নির্বাচনে যারা অন্যায়ভাবে আওয়ামী লীগকে জিততে সাহায্য করেন, তাদের অনেককেই পরবর্তীতে সংসদে বিভিন্ন মন্ত্রীর পদে দেখা যায়।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ
১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হানা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা এত বেশি ছিলো যে এ সময়ে অন্তত দেড় লাখ মানুষ মারা যান। যদিও সরকারি হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিলো ২৭ হাজার। আর এই দুর্ভিক্ষের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতিকে দায়ী করেন অনেকেই। যদিও তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে বাংলাদেশ কিউবার পক্ষ নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় আর তাই এই দুর্ভিক্ষ হয়। তবে অমর্ত সেনের একটি কেইস স্টাডিতে বলা হয় যে, আগের বছর গুলোর তুলনায় ৭৪ সালে খাদ্য উৎপাদন বেশি হয়। কিন্তু সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারনে এই খাদ্যের অসম বণ্টন হয় যার ফলে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ।
ভারতে পাচার
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনে আরও একটি কারণ ছিলো অবৈধভাবে ভারতে সম্পদ পাচার। তৎকালীন এক সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭২ থে ৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয় ২০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্রব্য। এ ছাড়াও সালাউদ্দিন আহমেদের লেখা ‘পাস্ট অ্যান্ড প্রেসেন্ট’ বইতে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র লুট করে ১৫টি জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে যায় ভারত। তৎকালীন সময়ে যার বাজার মূল্য ছিলো ২৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও তারা বিভিন্ন কারখানার যন্ত্রপাতি, মেশিন ও অন্যান্য সরঞ্জামও লুট করে যার বাজার মূল্য ছিলো ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর এসব লুটপাটের প্রতিবাদ করায় সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে রাজবন্দী বানানো হয়। এমনকি তাঁর মুক্তিযোদ্ধা খেতাবও ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
বাকশাল
দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, রক্ষিবাহিনীর অত্যাচার ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষ, সেনাবাহিনী এমনকি আওয়ামী লীগের ভিতরেরও দেখা দিচ্ছিলো অসন্তোষ। শেখ মুজিব হয়ত এর কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। আর তাই এই অসন্তোষ দমনে তিনি সামনে নিয়ে আসলেন ‘বাকশাল’। বাকশাল অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। আর এই বাকশালই ছিলো শেখ মুজিবের পতনের অন্যতম বড় কারণ। বাকশালের বিষয়টি ছিলো যে দেশে মাত্র একতি রাজনৈতিক দল থাকবে, বাকি সব দলকে বাকশালের সাথে মিশে যেতে হবে। আর এ ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। যা কিনা ছিলো ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের দেয়া ৬ দফার বিপরীত। এছাড়াও তিনি ৪টি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব গণমাধ্যমও বন্ধ করে দেন। ফলে সারা দেশে ঢালাও ভাবে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ মুজিবের সাফল্য প্রচারিত হতো।
নায়ক না একনায়ক?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করার পর ক্রমশ বাঙ্গালি জাতির নায়ক হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ এ তিনি সরাসরি স্বাধিনতার ঘোষণা না দিলেও তাঁর নামের উপর ভর করেই হয় রক্তক্ষয়ি মুক্তিযুদ্ধ আর অর্যিত হয় মহান স্বাধীনতা। কিন্তু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের বহু জানা অজানা ইতিহাস ইঙ্গিত করে যে তিনি হয়ত একজন ভালো শাসক ছিলেন না। এমনকি অনেকেই তাঁকে বলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম স্বৈরশাসক। তাঁর আমলেই কবি রফিক আজাদ তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা নাইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো’ লেখার জন্য জেলে ঢুকানো হয়। বাংলাদেশ সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারকেও শেখ মুজিবের আমলেই বিচারবহির্ভুত ভাবে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। যা ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্রস ফায়ার।
এসব কারণেই অনেকে বলেন শেখ মুজিব একজন ভালো নেতা হলেও ভালো শাসক ছিলেন না। আর তাই হয়ত একসময় তাঁর ভাষণে উদ্ভুদ্ধ হয়ে যে সব সেনা অফিসাররা মুক্তি যুদ্ধ করেছিলেন তারাই নির্মমভাবে স্বপরিবারে তাঁকে হত্যা করেন। যখন তাদের শেখ মুজিবকে হত্যা করার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো তারা বলেছিলেন, “আর কোন উপায় ছিলো না শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার।” সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড দেখেও মনে হয়, হয়ত তিনি পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছেন স্বৈরাচারী মনভাব।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: