দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক রক্ষা করবে কে?
টেকনাফ নেটং পাহাড়ে ৮২ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বাঙ্কার

নেটং পাহাড়ে
টেকনাফ উপজেলা এক ঐতিহাসিক চারণভূমি। টেকনাফের নেটং পাহাড়ে ৮২ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বাঙ্কার রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে দেশের অমূল্য এ সম্পদের প্রতি অবহেলা, সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং সংস্কারের অভাবে বিলীন হতে চলেছে ঐতিহাসিক স্থাপনাটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিদর্শনের নাম ফলক কিংবা সংক্ষিপ্ত পরিচয় উধাও হয়ে গেছে সময়ের পরিক্রমায়। ফলে স্থানীয়সহ পর্যটকরা এসব প্রাচীন নিদর্শনের সঠিক ইতিহাস জানতে হিমশিম খাচ্ছেন। যে নিদর্শন আছে সেগুলো এখন বিলুপ্তির পথে।
প্রায় শত বছর আগে দেশের সর্ব দক্ষিণে শেষ সীমানার নাম ছিল নেটং (পরীর পাহাড়)। কালের পরিবর্তনে নাফটেক বর্তমান টেকনাফ। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে যেমন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা চেনেন, তেমনি সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং টেকনাফকেও চেনে না অনেকে।
জানা যায়, নেটং পাহাড়ের চূড়ায় তিনটি প্রবেশমুখ বিশিষ্ট একটি বাঙ্কার রয়েছে। প্রায় ৮২ বছর ধরে ওই বাঙ্কার তিনটি পাহাড়ের সম্মুখভাগে এখনও অক্ষত অবস্থায় শোভা পাচ্ছে। বাঙ্কারটি কখন তৈরি হয়েছিল তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। অনেকে বলছেন ১৯৪০-১৯৪৫ সালে জাপান সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সেনারা তখন পাহাড় কেটে অদ্ভুত বাঙ্কারটি নির্মাণ করেছিল। সেই রহস্যময় বাঙ্কারটির তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে উঠে আসে।
ব্রিটিশ-জাপানের যুদ্ধের আগে থেকে ‘বুদ্ধ ভান্ডের ধ্যানের গুহাটি ছিলো। মগ্নি মাস্টার ১৯৪০ সালের বৃদ্ধ নিজেও জানেন না বুদ্ধ ভান্ডের ধ্যানের গুহাটি কোন সালে নির্মাণ করেছিল। তবে এ গুহার মধ্যে বৌদ্ধরা প্রার্থনা করতো এবং মূল্যবান মূর্তি ছিল গুহাটির ভিতর।
দেখা যায়, তাদের ধ্যানের আসন আর নিছে আছে বুদ্ধদের শ্মশান। ঐ গুহার উপরে বা নেটং পাহাড়ের উপরে ছিলো ছিলো বড় মূর্তি বা নেংড ডে জাদি। যা ধ্যানের পর জাদিতে গিয়ে প্রার্থনা করতো। নেংড ডে বা জাদি পুনঃসংস্কার করেছিল ১৮৪১ সালে। ব্রিটিশ আর জাপানের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা কামান মেরে তছনছ করে দেয়।
স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অর্থাৎ ১৯৪১ সালে মগরা (রাখাইন) মংডুতে মুসলমান নিধন শুরু করে। এর রেশ ধরে টেকনাফেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কয়েক হাজার মগ সঙ্গে নিয়ে জাপান সেনারা নাফনদী অতিক্রম করে টেকনাফে ব্রিটিশ সেনাদের হটিয়ে দেয়। কিছুদিন পর কলকাতা থেকে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ সেনা এসে জাপান সেনাদের হটিয়ে টেকনাফ পুনরুদ্ধার করে। এই দখল-বেদখল ঘটনায় এবং মগ-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষের রক্তে নাফনদী রঞ্জিত হয়েছিল। এরপর টেকনাফে মগ-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্রিটিশরা ১৯৪২ সালে মগ জমিদার ক্যজাফ্র্যূ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে টেকনাফ পিস কমিটি (শান্তি কমিটি) গঠন করেন। বুদ্ধ ও মুসমাদের মধ্যে শান্তি ফিরে আনার লক্ষ্যে উক্ত কমিটি গঠন করেছিল তৎকালীন সময়। কমিটির মধ্যে ছিল আয়ু আলী সওদাগর, টেকনাফ সাবরাং এলাকার এজাহার আহমদ কেরানী জালিয়া পাড়ার আবদুল শুক্কুর বলি ও ছেবর বলি।
থানায় মোট নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ করা হয় ৪৫ জন। তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসক আজগর আলী শাহ, বিচারক (এসডিও) সলিমুল্লাহ খাঁন এবং এসকে দেওলভি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ এবং মগ-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে টেকনাফ এসে কয়েক দফা সভা-সমাবেশ করেন। ১৯৪২ সালে মার্চ মাসে মহকুমা প্রশাসক আজগর আলীর নেতৃত্বে ৫০ জন ব্রিটিশ সেনা দাঙ্গায় মগদের উস্কানির অভিযোগে পিস কমিটির চেয়ারম্যান ক্যজাফ্রু চৌধুরীকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে যান এবং এক মাসের কারাদণ্ড দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে টেকনাফ পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। টেকনাফের নাইট্যং পাহাড়ের চূড়া বা আশপাশে এখনও তাজা গ্রেনেড বা মর্টারশেল পাওয়া যাচ্ছে, অনেকের মতে এসব ব্রিটিশ সেনাদের ওই সময় ফেলে যাওয়া অস্ত্রভাণ্ডারের অংশ বিশেষ মাত্র। ওই নেটং পাহাড়ে অনুসন্ধান চালালে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র গ্রেনেড মর্টারশেলসহ ল্যান্ড মাইন পাওয়া যেতে পারে। দীর্ঘ কয়েক যুগ আগের পরিত্যক্ত এই ব্রিটিশ বাঙ্কারটি ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে আবিষ্কার করে পর্যটকদের দেখার সুযোগ করে দেন টেকনাফ উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুহসিন চৌধুরী।
তবে মগ্নি মাস্টার বা মগা মাস্টার দাবী করে বলেন, এটা কোন ব্রিটিশ বা জাপানের বাঙ্কার নয়। এটা হচ্ছে আমাদের ধ্যানের আসন, এখানে আমাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। কয়েকবার গিয়ে ধ্যানের গুহাটি পরিস্কার করে দিয়ে আসি তিনি আরো বলেন, ১৯৫২ সালে যখন টেকনাফ বাজারে আগুন লেগে, সব ডকুমেন্ট কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যা ক্যজাফ্রু চৌধুরীর বাড়িতে রাখাছিল। সচেতনমহল বলেন, বাঙ্কারটি পরিদর্শনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টেকনাফের পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, সেই ঐতিহাসিক জায়গা সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান কে নিয়ে উক্ত স্থান পরিদর্শন করতে যাবেন বলে জানান এ কর্মকর্তা। পুরোনো এই জায়গাটি দর্শক নন্দিন ও স্থানীয়সহ পর্যটকরা যাতে সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
বিভি/এইচএস
মন্তব্য করুন: